শুক্রবার, ১৮ মে, ২০০৭

বড়োদিনের চিঠি

মূল: আন্তন চেখভ
রূপান্তর: মোসতাকিম রাহী
...................................................................................................
'বড়োদিনের চিঠি' আন্তন চেখভের Vanka গল্পের ইংরেজি অনুবাদ থেকে বাংলায় রূপান্তর করা হয়েছে। প্রথম প্রকাশিত হয় 'দৈনিক সমকালে'র সাহিত্যসাময়িকী 'কালের খেয়া'তে।
......................................................................................................
সংক্ষেপে চেখভ:ভূমিদাস দাদুর নাতি,মুদি-দোকানি পিতার পুত্র আন্তন পাভলোভিচ চেখভ পেশায় ছিলেন ডাক্তার। জন্মগ্রহণ করেন ১৮৬০ সালের ২৯ জানুয়ারি দক্ষিণ রাশিয়ার ‘আজভ’ সাগর তীরবর্তী শহর তাগানরগে। পাঁচ ভাই এক বোনের মধ্যে চেখভ ছিলেন তৃতীয়। সাত বছর বয়সে ১৮৬৭ সালে চেখভ ‘গ্রীক বালক বিদ্যালয়ে’ ভর্তি হন, একবছর সেখানে লেখাপড়ার পর চলে আসেন ‘তাগানরগ গ্রামার স্কুলে’। এই ইস্কুল থেকেই চেখভ সাফল্যের সাথে মাধ্যমিক পাশ করেন ১৮৭৯ সালে। দারিদ্র পীড়িত পরিবারের করুণ অবস্থা কিশোর চেখভের মনে দারুণভাবে ছাপ ফেলে। পড়াশোনার পাশাপাশি চেখভ বাবার ব্যবসায় সাহায্য করতেন। চেখভের যখন চোদ্দবছর (মতান্তরে ষোলোবছর) বয়স তখন তার পিতা ব্যবসায় পুরোপুরি ব্যর্থ হয়ে, ঋণের দায় এড়াতে মস্কো চলে আসেন সপরিবারে। চেখভ তাগানরগে রয়ে যান নিজের পড়াশোনা শেষ করার জন্যে। এই সময় গৃহশিক্ষতা করে নিজের পড়াশোনার খরচ যোগান চেখভ। ১৮৭৯ সালে মাধ্যমিক পাশ করে চেখভ মস্কোয় চলে আসেন পরিবারের কাছে। ভর্তি হন ‘মস্কো বিশ্ববিদ্যালয় মেডিকেল স্কুলে’। ডাক্তারি অধ্যয়নরত অবস্থায় চেখভ গল্প লেখা শুরু করেন,তা থেকে প্রাপ্ত সম্মানী দিয়ে মা এবং ভাইবোনদের সাহায্য করার জন্যে। প্রথম গল্প প্রকাশিত হয় ১৮৮০ সালে। কয়েকশো গল্প তাঁর প্রকাশিত হয় পত্রপত্রিকায়। এইসময়ে লেখা তাঁর গল্পগুলো হাস্যরসাত্মক হলেও,সামাজিক-পারিবারিক সমস্যাই ছিলো তাঁর গল্পের মূল বিষয়। ১৮৮২ সালে চেখভ প্রথম উপন্যাস -‘নেনুনঝায়ে পোবেদা’- লেখেন হাঙ্গেরীয় লেখক ‘মোর জোকাই’র উপন্যাসের অনুপ্রেরণায়। ১৮৮৪ সালে চেখভ যখন ডাক্তারি পাশ করে বের হন ততোদিনে তিনি প্রতিষ্ঠিত লেখক। ১৮৮৬ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর দ্বিতীয় পূর্ণদৈর্ঘ্য উপন্যাস ‘দ্য শূটিঙ পার্টি’(১৯২৬ সালে উপন্যাসটি ইংরেজিতে অনূদিত হওয়ার পর জনপ্রিয় রহস্যসাহিত্যিক ‘অগাথা ক্রিস্টি’ এই উপন্যাসের চরিত্র এবং পটভূমি নিয়ে লেখেন ‘দ্য মার্ডার অভ রজার অ্যাক্রয়েড’)।সফলতা আসতে শুরু করে স্রোতের মতো। ১৮৮৭ সালে তাঁর প্রথম গল্প সংকলন প্রকাশিত হয়, এবং আশাতীত সাফল্য লাভ করে। এবছরেই প্রকাশিত হয় তাঁর আরো একটি গল্প সংকলন, যেটার অনেকগুলো সংস্করণ মুদ্রিত হয় অল্প সময়েই। ১৮৮৮ সালে চেখভ ‘পুশকিন অ্যাওয়ার্ড’ লাভ করেন। ১৮৮৯ সালে তাঁর মঞ্চস্থ প্রথম নাটক ‘দ্য উড ডেমন’ ব্যর্থ হয়। নাট্যকার হিসেবে তিনি সফলতা লাভ করেন অনেকবছর পর। ১৮৯৮ সালে ‘দ্য সি-গাল’ মঞ্চস্থ হওয়ার পর তিনি খ্যাতি লাভ করেন। এরপর ‘আঙ্কল ভানিয়া’, ‘দ্য থ্রি সিস্টারস’ এবং জীবনের শেষ নাটক ‘দ্য চেরি অরচার্ড’ ভীষণ জনপ্রিয় হয়।১৯০৪ সালের ১৪ জুলাই মাত্র চুয়াল্লিশ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন এই প্রতিভাবান লেখক-নাট্যকার।
.....................................................................................................................

নয় বছর বয়সি ভাঙ্কা জুকভ তিনমাস ধরে কাজ শিখছে নামকরা জুতো নির্মাতা আলিয়াহিন এর কাছে। বড়োদিনের আগের রাতে বাড়ির কথা মনে করে ঘুম আসছিলো না তার। দাদুর কাছে চিঠি লেখার জন্যে সুযোগ খুঁজছিলো সে। মালিক, মালিকের বউ এবং কর্মচারীরা গির্জায় চলে যেতেই ভাঙকা মালিকের আলমারি থেকে কালির দোয়াত, মরচে ধরা নিবঅলা কলম আর দোমড়ানো মোচড়ানো একটা কাগজ নিয়ে লিখতে বসলো।

লেখা শুরু করার আগে বেশ কয়েকবার ভীত-চকিত দৃষ্টিতে জানালা, দরোজা এবং নিজের চারপাশে একবার চোখ বুলিয়ে নিলো সে। ছোটো একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সামনে রাখা বেঞ্চটার ওপর কাগজটা বিছিয়ে হাঁটু গেড়ে বেঞ্চের ওপর ঝুঁকে লিখতে শুরু করলো।

‘প্রিয় দাদু,বড়োদিনের শুভেচ্ছা জানবেন। প্রভু যিশুর জন্মদিনে মহান ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করি তিনি যেন আপনাকে দীর্ঘায়ু করেন। আপনি ছাড়াতো আমার আর কেউ নেই, ঈশ্বর আমার মা-বাবা দুজনকেই কেড়ে নিয়েছেন, আমার সবকিছুইতো আপনি।”

এ পর্যন্ত লিখে ভাঙকা থেমে পড়লো। দাদুর কথা বড়ো বেশি মনে পড়ে যাচ্ছে। জানালা দিয়ে বাইরের অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে বুকটা হু হু করে উঠলো তার। মানসপটে স্পষ্ট সে দেখতে পেল তার দাদুর কর্মকান্ড।
ভাঙকার দাদু কন্সতান্তিন মেকারিচ নৈশপ্রহরী হিসেবে কাজ করেন এক বাড়িতে। পঁয়ষট্টি বছর বয়সি নেশালু চোখের অধিকারী মেকারিচ হালকা-পাতলা শরীরের একজন শক্তসমর্থ, সদা হাস্যোজ্জ্বল মানুষ।
দিনের বেলা মেকারিচ চাকরদের রান্নাঘরে ঘুমান অথবা বাবুর্চির সাথে গল্পগুজব করে সময় কাটান। রাতের বেলা ভেড়ার চামড়ার তৈরি একটা চাদর গায়ে জড়িয়ে বাড়ির চারপাশে টহল দিয়ে বেড়ান, আর ছোটো কাঠের হাতুড়ি ‘ম্যালেট’ দিয়ে হাতের তেলোতে বাড়ি মেরে মৃদু কিন্তু স্পষ্ট শব্দ করেন, যাতে বাড়ির মালিক বুঝতে পারেন যে, তিনি কাজে ফাঁকি দিচ্ছেন না এবং চোর-ছ্যাঁচোড়েরা কেউ একজন পাহারায় আছে এই ভেবে কাছে ঘেঁষার সাহস না পায়।
এইসময় তার পোষা দুই কুকুর কাশতাঙকা আর ঈল তাকে অনুসরণ করে। ঈলের গায়ের রঙ কালো, বেজির মতো শরীর। অতিশয় বিনয়ী এবং আদুরে স্বভাবের ঈল কাউকে খারাপ চোখে দেখে না, নিজের মুনিবের মতোই ভদ্র ব্যবহার করে সে আগন্তুকদের সাথেও। কিন্তু তার এই আপাত ভদ্রতার আড়ালে যে একটা বদমাশ লুকিয়ে আছে সেটা আশপাশের লোকজনই শুধু জানে। কারো ভাঁড়ারে ঢুকে খাবার চুরি করা কিংবা গ্রামের কৃষকের বাড়ি থেকে মুরগি চুরি করাতে তার জুড়ি নেই। আর এ কারণে তাকে কতোবার যে পিটিয়ে আধমরা করা হয়েছে তার কোনো ইয়ত্তা নেই। কিন্তু তারপরও তার স্বভাবের কোনো পরিবর্তন হয়নি।
এই মুহূর্তে কোনো সন্দেহ নেই তার দাদু গেটের সামনে দাঁড়িয়ে গির্জার লাল জানালাগুলোর ওপর চোখ বোলাচ্ছেন। ভারী বুটের খটখট আওয়াজ তুলে চাকর চাকরানিদের সাথে মজা করছেন। ছোট্ট ম্যালেটটা তার কোমরে বেল্টে ঝোলানো। হাতে হাত ঘষে মেকারিচ ঠান্ডা তাড়াবার চেষ্টা করছেন, আর ফাঁকে ফাঁকে বাবুর্চি কিংবা কোনো চাকরানির পেটে গুঁতো মারছেন দুষ্টুমি করে।
‘নস্যি চলবে?’ চাকরানির উদ্দেশে জিজ্ঞাসা তাঁর। মহিলা হাত বাড়িয়ে একচিমটি তামাকের গুঁড়ো নিয়ে নাকে দিয়ে চিৎকার করে উঠলো। খুশিতে অট্টহাসিতে ফেটে পড়লেন মেকারিচ। বললেন, ‘সর্দির জন্যে খাসা জিনিস কিন্তু!’
তারা মজা করার জন্যে কাশতাঙকার নাকেও শুঁকালেন, শ্বাস টেনেই চমকে উঠলো কাশতাঙকা। অস্থিরভাবে মাথা দোলাতে দোলাতে বাইরে চলে গেল কুকুরটা। সঙ্গিনীর করুণ অবস্থা দেখে নস্যি নেওয়ায় অসম্মতি জানালো ঈল, কিন্তু তার লোকদেখানো বিনয়ী স্বভাবের কারণে লেজ নাড়াতে শুরু করলো মাথা নিচু করে।

চমৎকার আবহাওয়া। পরিষ্কার তাজা বাতাস বইছে চারিদিকে। দৃষ্টিগ্রাহ্য অন্ধকারে ছেয়ে আছে পুরো গ্রাম। তুষারে ঢাকা গ্রামের বাড়িগুলোর শাদা ছাদ জ্বলজ্বল করছে অন্ধকারেও; আর চিমনি থেকে বেরিয়ে আসা কুন্ডলি পাকানো ধোঁয়া সহজেই নজর কাড়ে।
গাছগুলো ঢেকে আছে শ্বেত-শুভ্র তুষারে। আকাশে ঝিলমিল করছে তারকারাজি। সারা আকাশ যেন কিসের আগমনী বার্তা ঘোষণা করছে। পুরো ব্রহ্মান্ড মনে হয় স্নান করে নিজেকে পুত-পবিত্র করে নিয়েছে বড়োদিনের খুশিতে।বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো ভাঙকার। দোয়াতে কলম ডুবিয়ে নিয়ে লিখতে শুরু করলো সে আবার।

“ গতকাল মালিক আমাকে খুব গালাগালি আর মারধোর করেছে। আমার চুলের মুঠি ধরে উঠোনে বের করে দিয়েছে। ভীষণ মেরেছে জুতো রাখার স্ট্রেচার দিয়ে, কারণ আমি তাদের বাচ্চাটাকে দোলনায় দোল দিতে দিতে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। গত সপ্তাহে মালিকের বউ আমাকে হেরিং মাছ পরিষ্কার করতে বলেছিলো, আমি মাছের লেজের দিক থেকে কাটা শুরু করেছিলাম বলে বেগম সাহেবা এসে মাছগুলো আমার মুখের ওপর ছুঁড়ে মারে। অন্য কর্মচারিগুলো সবসময় তামাশা করে আমাকে নিয়ে। প্রায়ই তারা আমাকে ভদকা আনতে পাঠায় শুঁড়িখানায়। কখনো বাধ্য করে মালিকের ঘর থেকে শশা চুরি করে আনার জন্যে, আর মালিক একথা জানতে পেরে হাতের কাছে যা পায় তা-ই দিয়ে মারতে শুরু করে।
বেশি কষ্ট পাই খাবার নিয়ে, একদিনও পেট ভরে খেতে পারি নি এখানে,দাদু। সকালে সামান্য রুটি, দুপুরে খিচুড়ি আর রাতে আবার সেই রুটি। চা কিংবা স্যুপ কখনো কপালে জোটে না, মালিক আর তার বউই সব খেয়ে শেষ করে। রাতের বেলা শুতে দেয় বারান্দায় চলার পথে। তাদের বাচ্চাটা যখন কেঁদে ওঠে তখন আমার ঘুম হারাম হয়ে যায়। কারণ, বাচ্চাটাকে দোলনা দিয়ে ঘুম পাড়াতে পাড়াতে অনেক সময় লেগে যায়।

প্রিয় দাদু, প্রভু যিশুর দোহাই লাগে, আমাকে এখান থেকে নিয়ে যান। আমি আর সহ্য করতে পারছি না। নতমস্তকে আমি আপনার কাছে প্রার্থনা করছি দাদু, আমাকে নিয়ে যান, নইলে আমি মরে যাবো।
বিড়বিড় করে কথা বলছে ভাঙকা। দুচোখ বেয়ে জল গড়াচ্ছে। শীর্ণকায় দুই হাত দিয়ে চোখের জল মুছতে মুছতে লিখে যাচ্ছে।

‘আমি আপনার তামাক সাজিয়ে দেবো, দাদু। ঈশ্বরের কাছে আপনার জন্যে প্রার্থনা করবো। যদি কোনো ভুল করি আপনার যেভাবে খুশি আমাকে শাস্তি দেবেন দাদু। রোজগারের জন্যে আপনি কোনো চিন্তা করবেন না, দরকার হলে আমি নায়েবের জুতো পরিষ্কার করবো। নয়তো মেষপালকের চাকরি নেবো।
প্রিয় দাদু, আমি আর সহ্য করতে পারছি না, এরা আমাকে মেরে ফেলবে। আপনি আমাকে এখান থেকে নিয়ে যান। আমি অনেকবার পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছি, কিন্তু আমার জুতো নেই বলে পারি নি। বাইরে এতো বেশি বরফ যে, খালি পায়ে কিছুদূর গেলেই পা জমে যাবে। সেই ভয়ে যেতে পারি নি।
‘প্রিয় দাদু, আমি যখন বড়ো হবো তখন আপনার দেখাশোনা করবো। আপনার যাতে কোনো অসুবিধা না হয় সেদিকে খেয়াল রাখবো। আর আপনি যদি কখনো মারা যান আমি আপনার আত্মার শান্তির উদ্দেশে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করবো, যেভাবে আমি আমার মায়ের জন্যে সবসময় করি।

‘মস্কো খুব বড়ো শহর। শিক্ষিত, ভদ্রশ্রেণির লোকদের বসবাস এখানে। প্রচুর ঘোড়া আছে এই শহরে, কিন্তু কোনো ভেড়া নেই। আর এই শহরের কুকুরগুলো কিন্তু মোটেও হিংস্র নয়। এখানকার তরুণরা বড়োদিনে কখনো তারকা হাতে দুয়ারে দুয়ারে গান করতে যায় না। একদিন একটা দোকানে দেখলাম মাছ ধরার ছিপ-বড়শি রাখা হয়েছে বিক্রি করার উদ্দেশে। প্রায় সবধরণের মাছ ধরার জন্যে তৈরি করে সুতো-বড়শি সমেত। সবচেয়ে মজবুত ছিপ যেটা ছিলো সেটা দিয়ে অনায়াসে চল্লিশ পাউন্ড ওজনের যে-কোনো মাছ তুলে আনা যাবে।
আমি অনেক দোকান দেখেছি এই শহরে যেখানে প্রায় সবধরণের বন্দুক কিনতে পাওয়া যায়। যদিও সেটা আমাকে খুব বেশি বিস্মিত করতে পারেনি মালিকের বন্দুকটা আগে দেখেছিলাম বলে। কসাইয়ের দোকানগুলোতে পাখি, বনমোরগ, মাছ আর খরগোশও কিনতে পাওয়া যায়। কিন্তু দোকানিরা ভুলেও কখনো বলে না কোত্থেকে তারা সেগুলো ধরেছে।

‘প্রিয় দাদু, আপনার মালিকের বাড়িতে যখন ক্রিসমাস ট্রি নিয়ে আসবে, আমার জন্যে সোনালি কাগজে মোড়ানো একটা বাদাম আলাদা করে সবুজ ট্রাঙ্কে রেখে দেবেন। তরুণী ওলগা নাতিয়েভনাকে আমার কথা বললেই তিনি দেবেন।'

ফোঁস করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো ভাঙ্কা। জানালা পথে আবারো তার দৃষ্টি চলে গেলো বাইরে। তার মনে পড়ছে কী ভাবে তার দাদু তাকে নিয়ে জঙ্গলে যেতেন ক্রিসমাস ট্রি সংগ্রহ করার জন্যে। কতো মজার দিন ছিলো সেইসব! জঙ্গলে ঢুকে দাদু জোরে গলা খাঁকারি দেন, আর অমনি হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ে গাছের ওপরের হালকা বরফের স্তর। সেটা দেখে খুশিতে হেসে ওঠে ভাঙ্কা। ক্রিসমাস ট্রি কাটার আগে দাদু আয়েস করে পাইপ টানেন, অল্প একটু নস্যি নেন, আর ঠান্ডায় জমে যাওয়া ভাঙ্কার দিকে তাকিয়ে হাসেন।
কচি ফার গাছগুলো তুষারের বোঝা নিয়ে স্থির দাঁড়িয়ে থাকে, কার আগে কে কাটা পড়ে সেটা দেখার ইচ্ছেতেই বোধহয়। এমন সময় হঠাৎ করে একটা খরগোশ জ্যা-মুক্ত তীরের মতো লাফ দিয়ে বেরিয়ে আসে গাছের ভেতর থেকে। কর্কশ চিৎকার দিয়ে ওঠেন দাদু, ‘ধর! ধর! লেজকাটা শয়তানটা পালিয়ে গেলো।‘
যখন সে গাছটা কেটে নামায়, দাদু সেটা টেনে নিয়ে গিয়ে বাড়িতে তোলেন। তারপর লেগে যান সাজানোর কাজে। ভাঙ্কা যাকে সবচে বেশি পছন্দ করে, যুবতী ওলগা ইগনাতিয়েভনা হচ্ছে সবচে’ ব্যস্ত মহিলা। যখন ভাঙ্কার মা বেঁচে ছিলেন তিনিও কাজ করতেন সেই বাড়িতে। আর ওলগা তাকে আদর করতো ভীষণ। তাকে লিখতে পড়তে শিখিয়েছে। একশো পর্যন্ত গুনতে শিখিয়েছে। এমনকি তাকে নাচতে পর্যন্ত শিখিয়েছে। কিন্তু ভাঙ্কার মা যখন মারা গেলেন, ভাঙ্কার স্থান হলো তার দাদুর সাথে চাকরদের রান্নাঘরে। আর সেই রান্নাঘর থেকে এখন মস্কোতে জুতো কারখানায়।

‘আপনি দয়া করে আসুন, দাদু,’ ভাঙকা আবার লিখতে শুরু করলো। ‘প্রভু যিশুর দোহাই, আমাকে এখান থেকে নিয়ে যান। এই অমানুষগুলোর আচরণ আমাকে প্রতি মুহূর্তে মনে করিয়ে দেয় আমি অনাথ-অসহায়। আমাকে ওরা ঠিকমতো খেতে দেয় না, দাদু। ক্ষুধার কষ্ট কী সেটা আমি আপনাকে বোঝাতে পারবো না। আরেকদিন মালিক আমাকে জুতো বানানোর ভারী ছাঁচ দিয়ে মাথায় আঘাত করেছে, যার ফলে আমি মাটিতে পড়ে গিয়েছিলাম। কুকুরের চেয়েও অধম এখানে আমার জীবন,দাদু। আলিওনা, গাড়োয়ান আর কানা ইয়েগোর্কাকে আমার শুভেচ্ছা দেবেন। আর আমার কনসার্টিনাটি কাউকে দেবেন না।

ইতি,
আপনার আদরের নাতি
ইভান জুকভ

চিঠি শেষ করে ভাঙকা কাগজটা ভাঁজ করে খামের ভেতর ঢোকালো। গতকাল এক কোপেক দিয়ে খামটা সে কিনে এনেছিলো বাজার থেকে। সামান্য একটু ভেবে নিয়ে খামের ওপর ঠিকানা লিখলো সে:

প্রাপক,
দাদু

দু’হাতে মাথা আঁকড়ে ধরে কিছুক্ষণ ঝিম মেরে বসে রইলো ভাঙকা। তারপর আরো যোগ করলো:
‘কন্সতান্তিন মেকারিচ।’

কাজ শেষ করে উল্লসিত হয়ে উঠলো ভাঙকা, কারণ চিঠি লেখার সময় কেউ তাকে দেখতে পায় নি। তাড়াতাড়ি ক্যাপটা পরে নিয়ে কোট ছাড়াই দৌড়ে বাইরে চলে এলো সে। কসাইখানার লোকটাকে একদিন জিজ্ঞেস করায় সে বলেছিলো, কোথাও চিঠি পাঠাতে হলে সেটা ডাকবাক্সে ফেলতে হয়। আর সেখান থেকে তা সারা দুনিয়ায় পাঠানো হয়।
ভাঙকা দৌড়ে কাছের ডাকবাক্সটির কাছে গেলো। ছোটো ফোকর দিয়ে চিঠিটা বাক্সের ভেতর ফেললো। ঘন্টাখানেক পরে খুশিমনে ভাঙকা ঘুমিয়ে পড়লো এই ভেবে যে, খুব শীঘ্রি দাদু তাকে নিয়ে যাবে এই নরক থেকে। ঘুমের ভেতর ভাঙকা স্বপ্ন দেখলো তার দাদু রান্নাঘরে চুলোর পাশে বসে পা নাড়াতে নাড়াতে চিঠিটা পড়ে শোনাচ্ছেন বাবুর্চিকে। আর দাদুর পাশে লেজ নাড়াতে নাড়াতে চক্কর দিচ্ছে দাদুর পোষা কুকুর ঈল।
.................

কোন মন্তব্য নেই: