রবিবার, ১৭ জুন, ২০০৭

লটারি

মূল: মুনশি প্রেমচাঁদ
রূপান্তর: মোসতাকিম রাহী
.......................................................................................................
আধুনিক হিন্দি সাহিত্যের জনক মুনশি প্রেমচাঁদের 'লটারি' গল্পটি বাংলায় রূপান্তর করেছিলাম মূল হিন্দি থেকে। প্রকাশিত হয় 'আজকের কাগজ'এর সাহিত্যসাময়িকী 'সুবর্ণরেখা'তে।
......................................................................................................
সংক্ষেপে প্রেমচাঁদ: প্রেমচাঁদের আসল নাম ধনপত রায় শ্রীবাস্তব। আধুনিক হিন্দি সাহিত্যের অন্যতম এই কথাশিল্পী জন্মগ্রহণ করেন ১৮৮০ সালের ৩১ জুলাই অবিভক্ত ভারতের বারাণসী জেলার লমহী গ্রামে। উর্দু ভাষায় তাঁর সাহিত্যের হাতে খড়ি, তখন তিনি ‘নবাব রায়’ ছদ্মনামে লিখতেন। ১৯০৭ সালে যখন বৃটিশ সরকার কতৃক তাঁর ‘সজ-এ-বতন’ গল্প সংকলনটি নিষিদ্ধ করা হয়, এবং এর সবকগুলো কপি জব্দ করে পুড়িয়ে ফেলা হয়, তখন থেকে তিনি ‘মুনশি প্রেমচাঁদ’ ছদ্মনামে লিখতে শুরু করেন এবং এই নামেই ব্যাপক পরিচিতি লাভ করেন। অতি অল্প বয়সে প্রেমচাঁদের মা-বাবা মারা যান, ফলে শৈশব কাটে তাঁর দারুণ দারিদ্র্যের মাঝে। ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করেন কৃতিত্বের সাথে। তারপর গ্রামের সরকারি স্কুলে মাসে ১৮ রুপি বেতনে চাকরি নেন। পরে সাব-ডেপুটি ইন্সপেক্টর হিসেবে শিক্ষা বিভাগে কাজ করেন। ১৯২১ সালে গান্ধীর ডাকে সাড়া দিয়ে তিনি সরকারি চাকরিতে ইস্তফা দেন। এরপর একটি ছাপাখানা খোলেন, এবং নিজের সম্পাদনায় প্রকাশ করেন ‘হংস’ নামক সাহিত্য পত্রিকা।সাহিত্যের প্রায় সব শাখাতে তাঁর দৃপ্ত পদচারণা ছিলো- গল্প, উপন্যাস, নাটক, অনুবাদ, চিত্রনাট্য কোনো কিছুই বাদ যায় নি। দুইযুগের সাহিত্যিক জীবনে লেখা প্রায় তিনশো ছোটো গল্প আট খন্ডে ‘মানসরোবর’ নামে প্রকাশিত হয়। তাঁর তেরোটি উপন্যাসের মধ্যে ‘গো-দান’, ‘রঙ্গভূমি’, ‘সেবাসদন’, ‘কর্মভূমি’, ইত্যাদি বিখ্যাত। প্রেমচাঁদ তাঁর গল্পে সাধারণ মানুষের মাঝে প্রচলিত ভাষা ব্যবহার করতেন। যে-কারণে চরিত্র অনুযায়ী উর্দু এবং ইংরেজি শব্দের ব্যবহার দেখা যায় তাঁর গল্পে। গি দ্য মপাসাঁ’র গল্পের মতোই সমাজের সবশ্রেণির, সব পেশার মানুষের কথা উঠে এসেছে তাঁর গল্পে। প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার সত্যজিত রায় তাঁর গল্প এবং উপন্যাস নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন। ১৯৩৬ সালের ১৮ অক্টোবর পরলোক গমন করেন এই কালজয়ী সাহিত্যিক।
........................................................................................................

তাড়াতাড়ি বড়োলোক হতে কে না চায়? আমাদের এখানে যখন প্রথম লটারির টিকেট বিক্রি শুরু হয় তখন আমার বন্ধু বিক্রমের বাবা-মা,চাচা এবং বড়ো ভাই প্রত্যেকে একটা করে টিকেট কেনে। কে জানে কার ভাগ্য খুলে যায়! কারো নামে যদি লটারি লাগে তো টাকাটা ঘরেই রইলো, এই ভেবে একাধিক টিকেট কেনা।
কিন্তু ব্যাপারটা বিক্রমের সহ্য হলো না। অন্যদের নামে লটারি উঠলে তার কী লাভ? খুব বেশি হলে পাঁচ-দশ হাজার টাকা তার হাতে ধরিয়ে দেবে, এই-ই তো! কিন্তু এতো অল্প টাকায় তার কী হবে! তার চায় অঢেল টাকা! জীবনের রঙ-রস উপভোগ করার অনেক স্বপ্ন তার, অনেক পরিকল্পনা আছে। সে সারা পৃথিবীত ঘুরে বেড়াতে চায়,একেবারে একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্ত পর্যন্ত। পেরু, ব্রাজিল, টিম্বাকটু, হনলুলু এসব জায়গায় যাওয়ার খুব শখ তার। তাও কোথাও গিয়ে দু-একমাস থেকে ফিরে আসা নয়, যেখানেই যাবে লম্বা সময় সেখানে থেকে সেখানকার সংস্কৃতি, রীতি-নীতি পর্যবেক্ষণ করবে। কারণ, বিভিন্ন দেশের মানুষের জীবনযাপনের ওপর বৃহদাকার একটা বই লেখার ইচ্ছে আছে তার। বড়ো একটা লাইব্রেরি খোলার ইচ্ছেও তার আছে, যেখানে থাকবে পৃথিবীর বিখ্যাত সব লেখকের বই। প্রয়োজনে দু’লাখ টাকা খরচ করবে সে লাইব্রেরির জন্যে। বাংলো, গাড়ি আর ফার্নিচারের কথাতো বলাই বাহুল্য!
বাপ-চাচা কারো নামে লটারি লাগলে পাঁচ হাজারের বেশি পাওয়া যাবে না। মায়ের নামে যদি ওঠে হয়তো বিশ হাজার টাকা তিনি দেবেন। কিন্তু বড়ো ভায়ের নামে উঠলে যে এক কানা কড়িও পাওয়া যাবে না, এটা হলফ করে বলা যায়। খুব অভিমান হলো বিক্রমের। নিজের বাপ-ভায়ের কাছ থেকেও সাহায্য কিংবা দান-খয়রাত হিসেবে কিছু নেওয়া তার কাছে অপমানজনক মনে হলো। কথায় আছে, কারো কাছে হাত পাতার চেয়ে কুয়োর পানিতে ডুবে মরা অনেক ভালো। কেউ যদি সংসারে নিজের স্থান তৈরি করতে না পারে, তো সংসার ত্যাগ করা-ই তার উচিৎ।
বিক্রম বেকার মানুষ, লটারির টিকেট কেনার জন্যে কে ওকে টাকা দেবে! অনেক চিন্তা-ভাবনা করে সে আমাকে বললো, ‘আচ্ছা আমরা দু’জনে মিলে লটারির টিকেট কিনলে কেমন হয়?’
ওর প্রস্তাব আমার পছন্দ হলো। আমি তখন একটা স্কুলে মাস্টারি করি। মাসে বিশ টাকা মাইনে পাই। কোনোমতে খেয়েপরে দিন যাপন করি। আমার মতো মানুষের দশটাকা খরচ করে লটারির টিকেট কেনা আর হাতি কেনা একই কথা। হ্যাঁ, লটারি পেয়ে গেলে সেই টাকা কোথাও খাটিয়ে কিংবা ব্যাংকে রেখে নিশ্চিন্তে খাওয়া-পরা চলতে পারে। মাসে চার হাজার টাকা যদি আসে, জনের ভাগে দুই হাজার করে মন্দ নয়।
বিক্রমকে বললাম, ‘আমারতো মনে হয় দু’হাজার টাকায় তুমি আরামসে চলতে পারবে।
উত্তেজিত হয়ে বিক্রম বললো,‘ ভিখারির মতো আমি থাকতে পারবো না, আমি রাজার হালে থাকতে চাই।’
‘দু’হাজার টাকায় সেটা তুমি সহজেই পারো।’
‘কিন্তু তুমি তোমার হিস্যা থেকে আমাকে দু’লাখ টাকা না দিলে আমি তো লাইব্রেরি বানাতে পারবো না।’
‘এটাতো অপরিহার্য নয় যে, তোমাকে অন্যদের চেয়ে আলাদা করে লাইব্রেরি বানাতে হবে।’
‘আমার লাইব্রেরিকে অবশ্যই অন্যদের চেয়ে আলাদা হতে হবে।’
‘এটা তুমি দাবি করতে পারো। কিন্তু আমার ভাগের টাকা থেকে তোমাকে আমি কিছুই দিতে পারবো না। আমার প্রয়োজনটা দেখো, তোমাদের অনেক সয়-সম্পত্তি আছে। তোমার ওপর তেমন কোনো দায়িত্বও নেই। কিন্তু আমার ওপর পুরো সংসারের বোঝা। দুই বোনের বিয়ে দিতে হবে, ভাইদের লেখাপড়া করাতে হবে। একটা বাড়ি তৈরি করতে হবে। আমিতো টাকাগুলো সোজা ব্যাংকে রেখে দেবো। তা থেকে যা সুদ আসবে সেটা দিয়ে কাজ চালিয়ে নেবো। এমন কিছু শর্ত জুড়ে দেবো, যাতে আমার অবর্তমানে কেউ অই টাকায় হাত লাগাতে না পারে।’
বিক্রম সহানুভুতির সুরে বললো,‘ ঠিক বলেছো, এই অবস্থায় তোমার কাছ থেকে কিছু চাওয়াটা অন্যায়। যাক, আমিই কোনো একটা ব্যবস্থা করে নেবো। কিন্তু একটা ব্যাপার কি খেয়াল করেছো, ব্যাংকের সুদের হার তো আজকাল অনেক কমে গেছে।’
আমরা বেশ কয়েকটা ব্যাংকে গিয়ে তালাশ করলাম। আসলেই সুদের হার খুব কম দিচ্ছে ব্যাংকগুলো। শতকরা দু’-আড়াই টাকা সুদে টাকা ফেলে রাখাটা বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। তারচেয়ে সুদে টাকা ঋণ দেওয়া শুরু করলে কেমন হয়? বিক্রমও সফরে যাবে না, দু’জন মিলে কারবার দাঁড় করে ফেলতে পারবো। কিছু অর্থ হাতে এসে গেলেই বিক্রম সফরে যাবে। লেনদেনের ব্যবসায় সুদও পাওয়া যাবে প্রচুর। কিন্তু যতোক্ষণ পর্যন্ত কারো জন্যে বিশ্বস্ত জামানত পাওয়া না যাবে, তাকে ঋণ দেওয়া হবে না। সে যতো সম্মানী মানুষই হোক না কেন। অবশ্য এর চেয়ে সম্পত্তির দলিল দস্তাবেজ রেখে টাকা দিলে আরো ভালো হয়, কোনো খটকা থাকবে না।যাক, টাকা খাটানোর রাস্তা তো ঠিক হলো। এখন টিকেটে কার নাম থাকবে সেটা হলো কথা। বিক্রমের নাম থাকবে, নাকি আমার? বিক্রম তার নাম লেখানোর আগ্রহ দেখালো। যদি তার নাম না থাকে টিকেটই কিনবে না সে। কোনো উপায় না দেখে আমি মেনে নিলাম। কোনোরকম লেখাজোকা না করেই, যে-কারণে পরে আমার সমস্যা হয়েছিলো।
শুরু হলো অপেক্ষার প্রহর গোনা, কবে টিকেট কিনবো! সকালে ঘুম ভাঙার সাথে সাথেই আমার চোখ চলে যেতো ক্যালেন্ডারের পাতায়। বিক্রমের বাড়ি আর আমার বাড়ি ছিলো পাশাপাশি। স্কুলে যাওয়ার সব খরচ বাঁচিয়ে পাঁচটাকা কোনোরকমে যোগাড় করা যায়। তারপরও ভাবতাম, যদি কিছু বাড়তি টাকা অন্য কোনোভাবে জোগাড় করা যেতো তাহলে খুবই ভালো হতো!
বিক্রম বললো,‘আচ্ছা, আমার আঙটিটা বেচে দিলে কেমন হয়? বাড়িতে বলবো যে হারিয়ে গেছে!'
আঙটিটা দশটাকার কম হবে না। অই টাকা দিয়ে সহজেই টিকেট কেনা যায়। যদি কোনোরকম খরচ ছাড়াই টিকেটের অর্ধেক ভাগ পাওয়া যায় তাহলে মন্দ কী! কিন্তু আমার মতলব বোধহয় টের পেয়ে গেলো বিক্রম। বললো,‘পাঁচটাকা তোমাকে টিকেট কেনার আগেই নগদ দিতে হবে। তা না হলে আমি কিন্তু নেই।’
ওর কথা শুনে আমার ভেতর ন্যায়বোধ মাথাচাড়া দিয়ে উঠলো। বললাম,‘ এটা কিন্তু ঠিক হবে না, কেউ যদি বুঝতে পারে যে তুমি আঙটি বেচে দিয়েছো, তাহলে কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে! তোমার সাথে আমাকেও অপমানিত হতে হবে।’
শেষ পর্যন্ত স্থির হলো আমাদের পুরোনো পাঠ্যবই বিক্রি করে সেই টাকায় টিকেট কেনা হবে। এই মুহূর্তে লটারি কেনার চেয়ে দরকারি কাজ আর কিছু নেই। আমি আর বিক্রম একসাথে মেট্রিক পাস করেছি। কিন্তু যখন দেখলাম কষ্ট করে যারা লেখাপড়া করে ডিগ্রি হাসিল করছে, তাদের চেয়ে গন্ডমূর্খরা বেশ ভালো আছে, তখন দু’জনে লেখাপড়া বন্ধ করে দিলাম। আমি যোগ দিলাম ইস্কুলের শিক্ষক হিসেবে আর বিক্রম গেরস্থালি করতে লাগলো। আমাদের বইগুলো এখন উইয়ের খাদ্য হওয়া ছাড়া আর কোন্ কাজেই বা আসবে! গোলাঘরের এককোণে বইগুলো ফেলে রেখেছিলাম, বের করে সেগুলো ঝাড়ামোছা করে একটা বড়ো গাঁটরি বাঁধলাম দু’জনের গুলো মিলিয়ে। ইস্কুলমাস্টার হিসেবে সবাই আমাকে চেনে। তাই কোনো দোকানে গিয়ে বইগুলো বেচতে লজ্জা লাগছিলো। বাধ্য হয়ে বিক্রমকেই এই মহৎ কর্মটি সাধনের ভার দেওয়া হলো। আর সে মাত্র আধঘন্টার ভেতর দশটাকার একটা নোট হাতে নাচতে নাচতে আমার কাছে ফিরে এলো। এতো খুশি তাকে আমি আগে কখনো দেখিনি। বইগুলো যদিও চল্লিশটাকার কম হবে না, কিন্তু এই মুহূর্তে আমাদের কাছে মনে হচ্ছিলো দশটাকা আমরা কুড়িয়ে পেয়েছি। এই টাকায় অর্ধেক ভাগ পাওয়া যাবে টিকেটের। দশলাখ টাকার পুরস্কার। পাঁচলাখ আমার, পাঁচলাখ বিক্রমের। এই দিবাস্বপ্নে মগ্ন ছিলাম আমরা দু’জন।
‘পাঁচলাখ কিন্তু কম টাকা নয়, বিক্রম,’ প্রসন্নচিত্তে ওকে বললাম। বিক্রম আমার মতো খুব একটা সন্তুষ্ট ছিলো না। বললো, ‘পাঁচলাখ কেন, এই মুহূর্তে পাঁচশো টাকাও আমার জন্যে অনেক। কিন্তু বহুবছরের স্বপ্ন-পরিকল্পনা বাদ দেওয়া কি এতোই সোজা! তবুও প্রোগ্রাম বদলাতে হবে। লাইব্রেরি গড়ার পরিকল্পনা বাদ, কিন্তু বিশ্বভ্রমণ তো আমাকে করতেই হবে।’
আমি আপত্তি করলাম,‘তুমি দু’লাখ টাকায় তো তোমার বিশ্বভ্রমণ শেষ করতে পারো!’
‘জি না, ওটার জন্যে বাজেট হলো সাড়ে তিনলাখ টাকা। বছরে পঞ্চাশ হাজার করে সাত বছরের প্রোগ্রাম।’

প্রতিদিন ইস্কুল থেকে ফেরার পর আমরা দু’জন একসাথে বসে এভাবে আমাদের স্বপ্ন রচনা করতাম। কথা বলতাম নিচুস্বরে, যাতে কেউ আমাদের কথা শুনতে না পায়। কারণ লটারির টিকেট কেনার রহস্য আমরা গোপন রাখতে চাইছিলাম। সত্যি সত্যি যদি লটারি লেগে যায় তাহলে লোকজন কী পরিমাণ অবাক হবে সেটা ভেবে ভীষণ আমোদ হতে লাগলো আমাদের। এখন সবাইকে টিকেট কেনার কথা বলে দিলে সেই মজাটা আর পাওয়া যাবে না।একদিন প্রসঙ্গক্রমে বিয়ের কথা উঠলো। বিক্রম দার্শনিকের মতো ভাব নিয়ে গম্ভীরগলায় বললো,‘ভাই, এসব বিয়ে-শাদির যন্ত্রণা সহ্য করা আমার কম্মো নয়! মেয়েছেলে মানেই ঝামেলা! বউয়ের খাই মেটাতে মেটাতে জীবন শেষ হয়ে যাবে।’
আমি তার সাথে একমত হতে পারলাম না। বললাম,‘বিয়ের পর খরচ একটু বাড়বে তা ঠিক, কিন্তু যতোক্ষণ পর্যন্ত দুঃখ-কষ্টের ভাগ নেওয়ার জন্যে একজন সঙ্গিনী না আসে তাহলে জীবনের মজাইতো অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। আমি বিয়ে-শাদির বিপক্ষে নই। হ্যাঁ, এটা অবশ্য ঠিক এমন একজন সাথি দরকার যে সারাজীবন সঙ্গে থাকবে। এমন সাথি একমাত্র স্ত্রী ছাড়া আর কেউ হতে পারে না।’
বিক্রম খেপে গেলো আমার কথায়। ‘তুমি থাকো তোমার মতো! কুকুরের মতো বউয়ের পেছন-পেছন ঘোরো, আর বাচ্চাকাচ্চার ক্যাঁওম্যাঁও কে ঈশ্বরের আশীর্বাদ মনে করে খুশিমনে জীবন যাপন করো। তোমাকে অভিনন্দন! আমি থাকবো স্বাধীন, মুক্তবিহঙ্গের মতো। যখন যেখানে মন চায় চলে যাবো, যা মন চায় করবো। ইচ্ছে হলো বাড়ি ফিরবো, নয়তো ফিরবো না। পাহারাদারের মতো সারাক্ষণ একজন খবরদারি করবে এটা আমি সহ্য করতে পারবো না। বাড়ি ফিরতে একটু দেরি হলেই জবাব চাইবে:‘কোন চুলোয় গিয়েছিলে এতোক্ষণ,অ্যাঁ?’ আর খুশিমনে হয়তো কোথাও যেতে বের হলাম তখন বাধা দিয়ে বলবে:‘কোথায় যাওয়া হচ্ছে মিনসের শুনি!’ দুর্ভাগ্যক্রমে যদি সেও সঙ্গী হয়, তাহলে তো কেল্লাফতে, পানিতে ডুবে মরা ছাড়া আর গত্যন্তর থাকবে না!‘ভাই, তোমার প্রতি আমি বিন্দুমাত্র সহানুভূতি দেখাতে পারছি না। বাচ্চার সামান্য সর্দি-কাশি হলে অস্থির হয়ে দৌড়ে যাও হোমিওপ্যাথিক ডাক্তারের কাছে। আর একটু বয়স হয়ে গেলে ছেলেরা মনেমনে চাইবে কখন তুমি পটল তুলছো, যাতে তারা ইচ্ছেমতো চলতে পারে। সুযোগ পেলে তোমাকে বিষ খাইয়ে মারবে, আর প্রচার করবে তোমার কলেরা হয়েছিলো। এই ঝামেলায় আমি নেই, ভাই।’
এমন সময় কুন্তি এলো। বিক্রমের ছোটো বোন। বছর এগারো হবে বয়স, ষষ্ঠশ্রেণিতে পড়ে, আর পরীক্ষায় নিয়মিত ফেল মারে। ভীষণ দুরন্ত আর বেয়াড়া মেয়ে। এতো জোরে সে দরোজা খুললো যে, চমকে গিয়ে আমরা লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়ালাম। বিক্রম রেগে গিয়ে বললো,‘অ্যাই বুড়ি শয়তান, কে বলেছে তোকে এখানে আসতে, অ্যাঁ?’
গোয়েন্দা পুলিশের মতো কুন্তি ঘরের চারিদিকে চোখ বুলিয়ে বললো, ‘তোমরা সারাক্ষণ কেবাড় বন্ধ করে এই ঘরে করোটা কী? যখনই আসি দেখি এখানে বসে আছো। কোথাও ঘুরতে যাও না, আড্ডা দিতে যাও না। কী মন্ত্র জপতে থাকো সারাক্ষণ দু’জনে মিলে?’
বিক্রম কুন্তির ঘাড় চেপে ধরে ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বললো,‘হ্যাঁ, একটা মন্ত্র জপছি, যাতে তাড়াতাড়ি তোর জন্যে একটা বর পাওয়া যায়, যে তোকে প্রতিদিন গুনে গুনে পাঁচটি চাবুক মারবে।’
‘এমন স্বামীকে বিয়ে করতে আমার বয়েই গেছে,’ নাক ফুলিয়ে জবাব দিলো কুন্তি। ‘আমি এমন কাউকে বিয়ে করবো যে আমার সামনে সবসময় মাথা নিচু রাখবে। আমি যা বলবো তা-ই করবে,আমার কথার অবাধ্য হবে না। মা বলেছেন লটারির পুরস্কার থেকে তিনি আমাকে পঞ্চাশ হাজার টাকা দেবেন। ব্যস, ঐ টাকায় ফূর্তি করবো। আমি তো দুই বেলা ঠাকুরের কাছে মায়ের জন্যে প্রার্থনা করি। মা বলেছেন, কুমারী মেয়েদের প্রার্থনা কখনো নিষ্ফল হয় না। আমার মন বলছে মা অবশ্যই লটারির পুরস্কারটা পাবেন।’
কুন্তির কথা মিছে নয়। আমার মনে পড়লো একবার নানাবাড়ি গিয়েছিলাম গ্রামে। তীব্র দাবদাহে চারিদিক শুকিয়ে মরুভূমি প্রায়। সামান্য বৃষ্টির জন্যে হাহাকার করছে সবাই। তখন গ্রামের সবাই চাঁদা তুলে একটা ভোজের আয়োজন করে যতো কুমারী মেয়ে আছে সবাইকে নিমন্ত্রণ করলো। আর ঠিক তিনদিনের মাথায় নামলো মুষলধারে বৃষ্টি। কুমারী মেয়েদের আশীর্বাদে যে কাজ হয়, এতে কোনো সন্দেহ নেই।আমি বিক্রমের দিকে তাকিয়ে চোখে ইশারা করলাম। সে আমার ইশারা বুঝতে পারলো। চোখেচোখে দু’জনে পরামর্শ করে নিলাম। বিক্রম কুন্তিকে বললো,‘আচ্ছা তোকে একটা কথা বললে কাউকে বলবি নাতো? না না, তুই খুব লক্ষ্মী মেয়ে, আমি জানি তুই কাউকে বলবি না। এখন থেকে আমি তোকে ভালো মতো পড়াবো, এবার তুই ঠিকই পাশ করতে পারবি। আসলে হয়েছে কী, আমরা দু’জনেও একটা লটারি কিনেছি। তুই ঈশ্বরের কাছে আমাদের জন্যেও একটু প্রার্থনা করিস, বোন। যদি লটারি পেয়ে যাই তাহলে তোকে সুন্দর সুন্দর গয়না গড়িয়ে দেবো। সত্যি বলছি!’
কিন্তু কুন্তি বিশ্বাস করলো না বিক্রমের কথা। আমরা দু’জনে শপথ করলাম। তারপরও সে শয়তানি করতে লাগলো। শেষমেশ কসম খেয়ে যখন বললাম তার পা থেকে মাথা পর্যন্ত সোনা আর হিরে দিয়ে মুড়ে দেবো, তখন সে রাজি হলো আমাদের জন্যে প্রার্থনা করতে। কিন্তু তার পেটে যে এই সামান্য কথা হজম হবে না সেটা আমরা ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারি নি। সে সোজা ভেতরে গিয়ে কথাটা মুহূর্তের মধ্যে রাষ্ট্র করে দিলো। শুরু হলো বকাবকি। মা-বাবা-চাচি যে-ই সামনে পাচ্ছে সে-ই দিচ্ছে বকুনি: কী দরকার ছিলো টাকা খরচ করার? নিশ্চয়ই মাস্টার এই বুদ্ধি দিয়েছে! এতোগুলো টাকা পানিতে ফেলে দিলি! বাড়িতে কতোজনে টিকেট কিনেছে, তোর কী প্রয়োজন ছিলো কেনার! ওরা পুরস্কার পেলে সেখান থেকে কি তোকে ভাগ দিতো না! এরপর শুরু হলো আমাকে ধোলাই:‘আর তুমিও মাস্টার, একটা অপদার্থ! ছেলেমেয়েদের ভালো কিছু শেখাবে কি, উল্টো তাদের কুমন্ত্রনা দিচ্ছো!’
বিক্রম আদরের ছেলে, তাকে বেশি আর কী বলবে! রাগ করে দু’-এক বেলা খাওয়া বন্ধ করে দিলেই সবার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়বে, উল্টো তাকে সাধাসাধি করতে করতে সবার জান বেরিয়ে যাবে। সবার রাগ এসে পড়লো আমার ওপর। ‘এই মাস্টারের সহচর্যে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে ছেলেটা!’ সবাই রায় ঘোষণা করলো।ছোটোবেলার একটা ঘটনা মনে পড়লো আমার। আমিও বিক্রমের মতো কৌশল অবলম্বন করে একবার বেঁচে গেছিলাম মারের হাত থেকে। সেবার দোলপূর্ণিমা উপলক্ষে একটা মদের বোতল আনা হয়েছিলো বাড়িতে। মামু অই সময় বেড়াতে এসেছিলেন আমাদের ওখানে। আমি করলাম কী, চুপিচুপি ভাঁড়াড়ে ঢুকে একটা গেলাসে করে কিছুটা শরাব নিয়ে খেয়ে ফেললাম। গলা জ্বলতে শুরু করলো, আর চোখ হয়ে গেলো টকটকে লাল। এমন সময় হঠাৎ কোত্থেকে মামু এসে হাজির হলেন। ধরে ফেললেন হাতেনাতে। আর এতোটা রেগে গেলেন তিনি যে, ভয়ে আমার কলজে শুকিয়ে গেলো। মা-বাবা সবাই মিলে বকাবকি শুরু করলেন। ভয়ে যখন আমি কাঁদতে শুরু করলাম, তারা শান্ত হলেন। আর সেদিন দুপুরে মামু বেহেড মাতাল হয়ে গান গাইতে লাগলেন। এরপর শুরু হলো হলো মড়াকান্না, তারপর মাকে গালাগালি করলেন, আর দৌড়ে দাদুকে গেলেন মারতে । শেষে বমি করতে করতে একসময় মাটিতে পড়ে গেলেন অজ্ঞান হয়ে।
বিক্রমের বাবা বড়ো ঠাকুর সাহেব এবং চাচা ছোটো ঠাকুর সাহেব দু’জনেই ছিলেন জড়বাদী। পূজা-অর্চনায় তাঁদের কোনো আগ্রহ ছিলো না, বরং হাসি তামাশা করতেন তা নিয়ে: পুরোপুরি নাস্তিক। কিন্তু এখন দেখলাম দু’জনেই খুব ঈশ্বর ভক্ত হয়ে উঠেছেন। বড়ো ঠাকুর সাহেব তো সকালে উঠেই চলে যান গঙ্গাস্নান করতে। আর পুরোটা সকাল মন্দিরে কাটিয়ে দুপুরবেলা সারা শরীরে চন্দন ঘষে নিয়ে বাড়ি ফেরেন। আর ছোটো ঠাকুর তো গরমজলে স্নান করার সময়ও রামনাম জপতে থাকেন। এরপর চলে যান পার্কে, সেখানে গিয়ে চড়ুই-কবুতরদের দানা খাওয়ান পরম আদরে।সন্ধ্যার সময় দু’ভাই বাড়ি ফিরে চলে যান ঠাকুরঘরে। তারপর প্রায় অর্ধেক রাত পর্যন্ত শোনেন ভগবত গীতার শ্লোক।
বিক্রমের বড়ো ভাই প্রকাশ সাধু-সন্ন্যাসীদের ওপর অগাধ আস্থা রাখে। প্রায়ই চলে যায় সে তাদের আস্তানায়, মঠে। সেখানকার ধুলোময়লা সাফ করে, আর দেবি মায়ের সেবায় লেগে থাকে সবসময়। লোকে বলে লোভ-লালসা ভালো নয়,পাপ; কিন্তু আমার মনে হয় এই যে আমরা ধর্মকর্ম করছি, দেবদেবির পূজা করছি, ব্রত পালন করছি, সবকিছুই কিছু না কিছু পাওয়ার লোভে। আমাদের ধর্ম, আমাদের বিশ্বাস টিকে আছে স্বার্থসিদ্ধির গোপন আকাঙ্ক্ষার ওপর। লোভ যে মানুষের চরিত্র, মন-মানসিকতা আমূল বদলে দিতে পারে, এটা আমার জন্যে একেবারে নতুন অভিজ্ঞতা।আস্তে-আস্তে যতোই লটারির ফলাফল ঘোষণার দিন ঘনিয়ে আসতো লাগলো ততোই আমাদের মানসিক শান্তি উবে যেতে লাগলো। সারাক্ষণ ঐ চিন্তায় শুধু মাথায় ঘোরে। মাঝেমাঝে নিজের ওপর আমার অকারণে রাগ হতে থাকলো যে, বিক্রম যদি আমাকে লটারির ভাগের টাকা না দেয় তাহলে আমি কী করবো! যদি সে অস্বীকার করে যে লটারিতে আমার কোনো ভাগ নেই, তাহলে? আমার কাছে তো কোনো সাক্ষীসাবুদ, প্রমাণপত্র কিছু নেই। সবকিছু নির্ভর করছে বিক্রমের মর্জির ওপর। ওর মনে যদি বদ মতলব থাকে তাহলেই সেরেছে! কিছুতেই আমি দাবি করতে পারবো না যে, লটারিতে আমারও ভাগ আছে। টুঁ শব্দও করতে পারবো না, করলেও কোনো লাভ হবে না। যদি তার মনে কুমতলব থাকে তাহলে সেটা এখনই বোঝা যাবে, আর যদি তা না থাকে তবে আমার সংকীর্ণতার কথা জানতে পেরে খুব আঘাত পাবে।
আমি জানি, বিক্রম মোটেও এরকম নয়; কিন্তু ধনদৌলত হাতে এলে ক’জনাই বা ঈমান ঠিক রাখতে পারে! এখনো তো টাকা হাতে আসে নি, ঈমানদার সাজতে অসুবিধে কী! পরীক্ষার সময় তো আসবে তখন,যখন দশলাখ টাকা হাতে আসবে। আমি নিজেকে জিজ্ঞেস করলাম, যদি টিকেট আমার নামে হতো, তাহলে আমি কি বিক্রম কে এতো সহজে পাঁচলাখ টাকা দিয়ে দিতাম? হয়তো বলতাম, ‘তুমি আমাকে পাঁচটাকা ধার দিয়েছিলে, তার বদলে দশটাকা নাও, একশো টাকা নাও, আর কী করবে!’ কিন্তু না, এরকম অমানুষ আমি হতে পারবো না।পরদিন আমরা পত্রিকা দেখছিলাম। এমন সময় হঠাৎ বিক্রম বললো, ‘যদি সত্যি সত্যি এখন লটারির পুরস্কারটা আমাদের নামে ওঠে, তাহলে আমার আফসোস হবে এই ভেবে যে, কেন শুধু শধু তোমার সাথে মিলে টিকেট কিনলাম!’ মুচকি হেসে সরল ভাবে কথাটা সে বললো। কিন্তু আমি বুঝতে পারলাম, এটা তার মনের প্রকৃত ছবি, যা দুষ্টুমির আড়ালে লুকোতে চাইছে সে।
আমি চমকে উঠে বললাম, ‘সত্যি! কিন্তু এই একই রকম অনুভূতি তো আমারও হতে পারে!’
‘কিন্তু টিকেট তো আমার নামে নেওয়া হয়েছে।’
‘তাতে কী?’
‘মনে করো, তুমিও যে টিকেটর ভাগিদার সেটা আমি অস্বীকার করলাম!’
মেরুদন্ড বেয়ে শীতল স্রোত বয়ে গেলো আমার। দু’চোখে আঁধার দেখলাম।‘কিন্তু আমি তোমাকে বদলোক মনে করি না,’ ফ্যাকাসে হেসে বললাম।
‘ঠিক, কিন্তু শয়তান সওয়ার হতে কতোক্ষণ! ভেবে দেখো, পাঁচলাখ! খুব কম টাকা নয় কিন্তু! মাথা ঘুরিয়ে দেওয়ার জন্যে যথেষ্ট।’
‘তো ঠিক আছে, এখনো সময় আছে, লেখাজোকা করে নিলেই হয়! আর কোনো সংশয় থাকবে না।’
বিক্রম হেসে বললো,‘তুমি বড়ো সন্দেহ বাতিক লোক,দোস্ত। আমি তোমার পরীক্ষা নিচ্ছিলাম। আমি কি কখনো তোমাকে ধোঁকা দিতে পারি! পাঁচলাখ কেন, পাঁচকোটি টাকাও যদি হয়্, আমার মনে কখনো খারাপি আসবে না, এ ব্যাপারে তুমি নিশ্চিত থাকো।’
কিন্তু তার এই আশ্বাস বাণী আমি মোটেও বিশ্বাস করতে পারলাম না। সন্দেহের যে-পোকা মনে ঢুকেছে, সেটা শুধু কেটেই চলেছে। আমি আবার বললাম, ‘এটা আমি খুব ভালো করেই জানি যে, তোমার মনে কোনো কলুষতা নেই, কিন্তু লেখাজোকা করে নিলে ক্ষতি কী!’
‘কী দরকার অযথা!’
‘অযথাই না হয় করলাম।’
‘করলে পাকা দলিলই করতে হবে। আর তাতে দশলাখ টাকার হিসেবে কোর্টের ফিস আসবে প্রায় সাড়ে সাত হাজার। কোনো প্রয়োজন আছে এতোগুলো টাকা জলে ফেলার!’
আমি মনে মনে ভাবলাম, শাদা কাগজে লিখে নিলে কেমন হয়? এটা হয়তো ঠিক যে, শাদা কাগজের লেখা দিয়ে আমি আইনের আশ্রয় নিতে পারবো না। কিন্তু সমাজের সামনে, লোকজনের সামনে তাকে ধোঁকাবাজ প্রমাণ করতে,তাকে লজ্জিত করতে তো পারবো। আর লোকনিন্দার ভয় কার নেই! লোকজনের সামনে অপমানিত হওয়ার ভয়, আইনের সাজার চেয়ে কোনো অংশে কম নয়।
‘শাদা কাগজে করলেও আমার কোনো আপত্তি নেই, ’বললাম আমি।
বিক্রম হাত নেড়ে মাছি তাড়ানোর ভঙ্গিতে বললো, ‘যে-কাগজের কোনো আইনি মূল্য নেই, সেটা করে কী লাভ?’
আমি নিশ্চিত হয়ে গেলাম যে, বিক্রমের মনে শয়তানি আছে। নয়তো একটা শাদা কাগজে লিখতে অসুবিধে কী? রেগে গিয়ে বললাম, ‘তোমার মাথায় এখন থেকেই বদ মতলব ঘুরপাক খাচ্ছে।’
নির্লজ্জের মতো সে বললো,‘ তুমি বলতে চাইছো, এই অবস্থায় তোমার খেয়াল খারাপ হতো না?’
‘মোটেও না, আমি এতো নীচ নয়।’
‘আরে রাখো, কী আমার সজ্জন লোক রে! কতো দেখলাম তোমার মতো ভালো মানুষ!’
‘ এক্ষুনি তোমাকে কাগজে লিখে দিতে হবে। তোমার ওপর আমার আর বিন্দুমাত্র আস্থা নেই।’
‘আমার প্রতি যদি তোমার আস্থা না থাকে তাহলে আমিও কোনো লিখিত কাগজ দেবো না।’
‘আচ্ছা! তো তুমি মনে করেছো আমার টাকা খেয়ে হজম করতে পারবে?’
‘কিসের টাকা তোমার, কেমন টাকা?’
‘দেখো বিক্রম, শুধু বন্ধুত্বই নষ্ট হবে না, তারচেয়েও ভয়ংকর কিছু ঘটে যাবে বলে দিচ্ছি!’ক্রোধের আগুন জ্বলে উঠলো আমার ভেতরে।এমন সময় হঠাৎ করে বৈঠকখানা থেকে ঝগড়ার আওয়াজ ভেসে আসায় আমার মনোযোগ সেদিকে চলে গেলো। সেখানে দুই ঠাকুর সব সময় বসে আড্ডা দেন। তাদের মধ্যে এমন বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিলো, যেটা শুধু দুই আদর্শ ভাইয়ের মধ্যে হতে পারে। একেবারে মানিকজোড়, ঠিক যেন রাম-লক্ষ্মণ! ঝগড়া দূরে থাকুক তাদের মধ্যে কখনো সামান্য কথা কাটাকাটি হয়েছে বলেও আমি শুনিনি। বড়ো ঠাকুর যা বলবেন ছোটো ঠাকুর তা মাথা পেতে নেবেন, আর ছোটো ঠাকুরের ইচ্ছে অনিচ্ছের প্রতি সম্মান দেখিয়েই বড়ো ঠাকুর কোনো সিদ্ধান্ত নিতেন। আমরা দুজন খুব অবাক হয়ে গেলাম এই বন্ধুপ্রতিম দুই ভাইয়ের মধ্যে ঝগড়া হচ্ছে বুঝতে পেরে। চুপিচুপি বৈঠকখানার দরোজায় গিয়ে দাঁড়ালাম দু’জন।

দুই ভাই ইতোমধ্যে নিজেদের চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছেন। চোখ লাল, হাতজোড়া মুঠি পাকানো, দাঁতমুখ খিঁচিয়ে একজন আরেকজনের দিকে অগ্রসর হচ্ছেন। বোঝা যায় শুধু হাতাহাতিটাই বাকি আছে।ছোটো ঠাকুর বিক্রমকে দেখতে পেয়ে বললো, ‘যৌথ পরিবারে যা কিছু আসুক, যেখান থেকে আসুক, যার নামেই আসুক না কেন, সেটা সবার নামে সমান ভাগে হিসাব হবে।’
বিক্রমের বাবাও বিক্রমকে দেখতে পেয়েছে। এক কদম সামনে এগিয়ে এসে বিক্রমের বাবা, অর্থাৎ বড়ো ঠাকুর বললেন, ‘মোটেও না, আমি যদি কোনো অপরাধ করি তাহলে পুলিশ আমাকে এসে ধরবে, যৌথ পরিবারকে নয়। শাস্তি আমি পাবো যৌথ পরিবারের কেউ পাবে না। এটা ব্যক্তিগত হিসাব।’
‘ঠিক আছে, এর ফয়সালা আদালতেই হবে।’
‘যাও, খুশিমনে আদালতে যাও। যদি আমার বউ ছেলে কিংবা আমার নামে লটারি ওঠে তাহলে তাতে তোমার কোনো অংশ থাকবে না। ঠিক তেমনি যদি তোমার নামে লটারি ওঠে তাহলে তাতে আমাদের কারো দাবি থাকবে না।’
‘যদি জানতাম, আপনার মনে কুমতলব আছে তাহলে আমিও আমার বউ-বাচ্চার নামের টিকেট কিনতে পারতাম।’
‘ওটা তোমার বোকামি!’
‘হ্যাঁ, কারণ আপনি আমার বড়ো ভাই, বিশ্বাস করেছিলাম আপনাকে।'
‘এটা হচ্ছে একধরনের জুয়াখেলা, তোমার বোঝা উচিৎ। জুয়ার হারজিতের সাথে পরিবারের কোনো সম্পর্ক নেই, থাকতে পারে না। তুমি যদি কাল রেসের বাজিতে পাঁচ-দশ হাজার টাকা হেরে যাও তোমার পরিবার তো তার জন্যে দায়ী হতে পারে না।’
‘ভাইয়ের হক খেয়ে আপনি সুখী হতে পারবেন না।’
‘শকুনের প্রার্থনায় কি আর গরু মরে ভাই!’

বিক্রমের মা ভেতর থেকে দৌড়ে এলেন দুই ভাইয়ের মধ্যে ঝগড়া লেগেছে শুনে। এসে দু’জনকে বোঝাতে লাগলেন। ছোটো ঠাকুর রেগেমেগে বললেন,‘আমাকে নয়, তুমি তাঁকে বোঝাও। আমি তো একটা মাত্র টিকেট কিনেছি, তার কোনো ভরসা নেই। উনি চার চারটি টিকেট কিনে বসে আছেন। আমার চেয়ে লটারি পাওয়ার চান্স তাঁর চারগুন বেশি। এরপরও যদি তার খেয়াল খারাপ হয়ে যায়, এরচেয়ে লজ্জার, দুঃখের কথা আর কী হতে পারে!’
ঠাকরুন দেবরকে আশ্বাস দিয়ে বললেন, ‘ আচ্ছা ঠিক আছে, আমার টাকা থেকে আমি তোমাকে অর্ধেক দিয়ে দেবো। খুশি তো?’
বড়ো ঠাকুর বউয়ের কথা শুনে ধমক দিয়ে উঠলেন, ‘কেন অর্ধেক দেবো, কোন হিসেবে দেবো? আমরা যদি ভালো মানুষি দেখিয়ে দেইও, সে পাবে পাঁচভাগের এক ভাগ। কোন যুক্তিতে তাকে অর্ধেক দেবো শুনি? ধর্মমতে বলো আর আইনমতে বলো।’
ছোটো ঠাকুর মুখ ভেংচে বললেন, ‘হ্যাঁ, দুনিয়ার যাবতীয় আইনতো সব আপনিই জানেন!’
‘নয়তো কী, ত্রিশবছর ধরে ওকালতি করছি!’
‘ওকালতি সব বেরিয়ে যাবে যখন কলকাতার ব্যারিস্টার এনে সামনে দাঁড় করিয়ে দেবো।’
‘কলকাতার হোক আর লন্ডনের, আমি থোড়াই কেয়ার করি।’
‘অর্ধেক ভাগ আমি নেবোই। সম্পত্তিতে যেমন আমার অর্ধেক অংশ আছে লটারিতেও আমার অর্ধেক চায়।’

এমন সময় বিক্রমের বড়ো ভাই প্রকাশ হাতে মাথায় ব্যান্ডেজ, আর দোমড়ানো মোচড়ানো কাপড়চোপড়ে তাজা রক্তের দাগ নিয়ে একেবারে হাসিমুখে এসে আরামকেদারায় ধপাস করে বসে পড়লো। বড়ো ঠাকুর ঘাবড়ে গিয়ে বললেন, ‘এ কী হয়েছে তোর? চোট পেলি কী করে? কারো সাথে মারপিট করে আসছিস না তো?’
প্রকাশ আরামকেদারায় শোয়া অবস্থায় সামান্য আড়মোড়া ভেঙে বললো,‘জি না, ঘাবড়ানোর কোনো কারণ নেই, আমার কিছু হয় নি, আমি ভালো আছি।’
‘কী বলছিস কিছু হয় নি! মাথা আর হাতে চোট লেগে রক্ত বেরুচ্ছে! ব্যাপারটা কী, রাস্তায় কোনো দুর্ঘটনা হয়নি তো!’
‘একেবারে মামুলি আঘাত, বাবা, দু’-একদিনের মধ্যে ঠিক হয়ে যাবে। ভয়ের কিছু নেই।’প্রকাশের ঠোঁটে মুচকি হাসি। আশ্চর্য শান্ত তার হাবভাব। রাগ কিংবা অপমানের কোনো চিহ্ন তার চেহারায় নেই। প্রতিশোধ নেওয়ার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে তার মধ্যে দেখা যাচ্ছিলো না। বড়ো ঠাকুর অস্থির হয়ে গেলেন তার আচরণে। বললেন,‘কিন্তু কী হয়েছে সেটা বলছিস না কেন? কেউ মারধোর করে থাকলে বল, থানায় গিয়ে রিপোর্ট করে আসি।’
প্রকাশ হালকা মেজাজে বললো, ‘মারপিট কারো সাথে হয় নি, বাবা। তুফান বাবার আস্তানায় গিয়েছিলাম একটু। আপনি তো জানেন, উনি লোকজন দেখলেই পাথর নিয়ে তাড়া করেন। আর ভয় পেয়ে যদি কেউ দৌড় দেয়, তাহলে ঐ বেচারা মরেছে! আর যে ইট-পাটকেল খেয়েও বাবার পিছে লেগে থাকবে, তার কপাল খুলে যাবে। পরশপাথর যে সে পাবে এতে কোনো সন্দেহ নেই। আসলে উনি এভাবে লোকজনকে পরীক্ষা করেন। আজ আমি ওখানে গিয়েছিলাম। প্রায় পঞ্চাশজন লোক আজ উপস্থিত ছিলো। কেউ মিষ্টি, কেউ কাপড়, কেউ দামি উপহার নিয়ে গেছে বাবার কৃপাদৃষ্টিলাভের আশায়। তুফান বাবা তখন ধ্যান করছিলেন। চোখ খুলে যখন সমবেত লোকদের দেখতে পেলেন, ব্যস, পাথর নিয়ে দৌড়ে এলেন আমাদের দিকে। শুরু হয়ে গেলো দৌড়ঝাঁপ। যে যেদিকে পারে ছুটে পালালো। মুহূর্তের মধ্যে খালি হয়ে গেলো বাবার আস্তানা। একা আমি দাঁড়িয়ে রইলাম ঝিম মেরে। উনি আমাকে পাথর ছুঁড়ে মারলেন। প্রথমটা এসে লাগলো মাথায়। ওনার নিশানা একেবারে অব্যর্থ। মাথা ফেটে রক্ত পড়তে শুরু করলো। কিন্তু আমি নড়বার পাত্র নই। এরপর উনি দ্বিতীয় পাথরটা মারলেন, হাতে এসে লাগলো ওটা। যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে বেহুঁশ হয়ে পড়ে গেলাম। যখন হুঁশ ফিরে এলো, দেখলাম বাবার আস্তানায় কেউ নেই, একেবারে নীরব হয়ে আছে চারিদিক। তুফান বাবাকেও কোথাও দেখতে পেলাম না। মনে হয় গায়েব হয়ে গেছেন। কাকে ডাকবো? কার কাছে সাহায্য চাইবো? মাথার ক্ষত থেকে তখনো রক্ত গড়াচ্ছে, অসহ্য ব্যথায় মনে হচ্ছে হাত ছিঁড়ে পড়ে যাবে। কোনোমতে হাঁচড়েপাচড়ে উঠে দাঁড়ালাম, সোজা চলে গেলাম ডাক্তারের কাছে। ডাক্তার দেখে বললেন হাড় ভেঙে গেছে। ব্যান্ডেজ বেঁধে দিয়ে বললেন, গরম সেঁক দিতে। হাড় ভেঙেছে এটা এমন বড়ো কিছু নয়, লটারির টিকেট যে আমার নামে উঠবে এটা এখন নিশ্চিত। তুফান বাবার মার খেয়েছে কেউ, কিন্তু মনোবাসনা পূরণ হয় নি, এমনটা কখনো হয় নি। আমি লটারি পেয়েই বাবার আস্তানা পাকা করে দেবো।’

বড়ো ঠাকুরের চেহারায় খুশির ছায়া খেলে গেলো। ত্বরিত বিছানা তৈরি হয়ে গেলো বিক্রমের জন্যে। প্রকাশ শুয়ে পড়লো সেই বিছানায়। ঠাকরুন তাড়াতাড়ি বিক্রমকে পাখা করতে লাগলেন। ছেলের সফলতার আশায় তার চেহারায়ও খেলা করছিলো এক অদ্ভুত প্রসন্নতা। সামান্য আঘাত সয়ে দশলাখ টাকা পেয়ে যাওয়া মোটেও সহজ কথা নয়! খিদের ঠ্যালায় ছোটো ঠাকুরের নাড়িভুঁড়ি হজম হয়ে যাচ্ছিলো। তবু এক পা-ও নড়ছিলেন না তিনি সেখান থেকে। যেই বড়ো ঠাকুর খাওয়ার জন্যে ভেতরে গেলেন আর ঠাকরুন প্রকাশের জন্যে খাবারের ব্যবস্থা করতে গেলেন, অমনি ছোটো ঠাকুর ছুটে এসে প্রকাশকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আচ্ছা, তুফান বাবা কি খুব জোরে পাথর মারেন?’
প্রকাশ ছোটো ঠাকুরের উদ্দেশ্য বুঝতে পেরে বললো,‘আরে কাকা, পাথর তো নয়, মনে হয় যেন গোলা ছুঁড়ে মারছে! পালোয়ানের মতো শরীর, এক ঘুষিতে বাঘকে পর্যন্ত পরাস্ত করতে পারেন। কতো লোক যে একটা মাত্র পাথরের আঘাতে পটল তুলেছে তার কোনো ইয়ত্তা নেই। অথচ আজ পর্যন্ত কোনো মোকদ্দমাই হয় নি তুফান বাবার বিরুদ্ধে। আর বাবাও দু’-চারটে পাথর মেরেই ক্ষান্ত হন না, যতোক্ষণ না আপনি বেহুঁশ হয়ে পড়ে যাচ্ছেন, ততোক্ষণ মারতেই থাকবেন। আর রহস্য এই, জখম যতো বেশি হবে, লক্ষ্য হাসিলের সম্ভাবনা ততোই বাড়বে।’
প্রকাশ এমন গল্প ফেঁদে বসলো যে, ছোটো ঠাকুর কুঁকড়ে গেলেন ভেতরে ভেতরে। তুফান বাবার আস্তানায় গিয়ে মার খাওয়ার সাহস হলো না।

শেষ পর্যন্ত ভাগ্য নির্ণয়ের দিন এসেই গেলো জুলাইয়ের বিশ তারিখ। কাকভোরে ঘুম থেকে উঠে পড়লাম। আশা আর ভয়ের দোলাচলে ঠিকমতো ঘুমাতে পারি নি রাতভর। বড়ো-ছোটো দুই ঠাকুর গঙ্গাস্নান সেরে মন্দিরে পুজো দিতে গেলেন। আজ আমার মনেও ভক্তি জেগে উঠলো। ভাবলাম মন্দিরে গিয়ে পূজা দিয়ে আসি।
‘হে প্রভু! তুমি অনাথের সহায়, আশ্রয়হীনের আশ্রয়, তুমি অন্তর্যামী, আমরা কতো কষ্ট করে টিকেট কিনেছি সেটা তুমি জানো প্রভু। তোমার কৃপাদৃষ্টি কি আমাদের ওপর পড়বে না প্রভু? আমাদের চেয়ে তোমার কৃপা পাওয়ার যোগ্য আর কে আছে?’
বিক্রম একেবারে সুটবুট পরে মন্দিরে হাজির। আমাকে ইশারা করে বললো,‘আমি ডাকঘরে যাচ্ছি!’ তারপর হাওয়া হয়ে গেলো। একটু পরে প্রকাশ মিষ্টির থালা হাতে নিয়ে মন্দিরের দুয়ারে দাঁড়িয়ে গরিবদের মাঝে বিলি করতে শুরুকরলো। দুই ঠাকুর তখনো ভগবানের চরণ ছুঁয়ে পড়ে আছেন। মাথা নিচু করে, চোখ বুজে একমনে প্রার্থনা করে চলেছেন।হঠাৎ বড়ো ঠাকুর মাথা তুলে পুরোহিতের দিকে চেয়ে বললেন, ‘ভগবান বড়োই ভক্তবৎসল, তাই না, পুরোহিত মশাই?’
পুরোহিত সমর্থন করলেন তাঁর কথা। বললেন,‘হ্যাঁ, বড়ো ঠাকুর, ভক্তের সুরক্ষার জন্যেই ভগবান ক্ষীরসাগর পাড়ি দিযেছেন, আর গজকে বাঁচিয়েছেন কুমিরের কবল থেকে।’
একটু পরে মাথা তুললেন ছোটো ঠাকুর। পুরোহিতের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘ভগবান তো সর্বশক্তিমান, অন্তর্যামী, সবার মনের খবর জানেন, তাই না পুরোহিত মশাই?’পুরোহিত তাঁর কথাও সমর্থন করলেন। বললেন,‘অন্তর্যামী না হলে সবার মনের কথা কী ভাবে বুঝতে পারেন? শবরীর প্রেমের গভীরতা দেখেইতো তার মনোকামনা পূর্ণ করলেন।’
পূজা সমাপ্ত হলো। যখন ভজন শুরু হলো দুই ভাই মিলে জোরে জোরে ভজন গাইতে লাগলেন। বড়ো ঠাকুর দুই টাকা দান করলেন পুরোহিতের সামনে রাখা থালায়। তা দেখে ছোটো ঠাকুর দান করলেন চার টাকা। বড়ো ঠাকুর কোপনজরে কিছুক্ষণ চেয়ে মুখ ফিরিয়ে নিলেন। তারপর পুরোহিতের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,‘আপনার মন কী বলছে পুরোহিত মশাই?’
‘আপনার জয় সুনিশ্চিত, বড়ো ঠাকুর!’
ছোটো ঠাকুর জিজ্ঞেস করলেন,‘আর আমার?’
‘আপনারও জয় হবে, ছোটো ঠাকুর!’
বড়ো ঠাকুর সশ্রদ্ধ চিত্তে ভজন গাইতে গাইতে মন্দির থেকে বেরিয়ে পড়লেন। আর তার পিছে পিছে ছোটো ঠাকুরও চললেন প্রভুর গুনগান গাইতে গাইতে।আমিও বেরিয়ে এলাম তাদের পিছুপিছু। বাইরে এসে প্রকাশ বাবুকে সাহায্য করতে চাইলাম মিঠাই বিতরণে। কিন্তু তিনি প্রত্যাখ্যান করে বললেন, ‘আমি একাই করতে পারবো, মাস্টার বাবু। আর বেশি তো বাকি নেই, ধন্যবাদ!’ আমি লজ্জা পেয়ে ডাকঘর অভিমুখে রওনা দিলাম। এমন সময় দেখলাম বিক্রম হাসিমুখে সাইকেল চালিয়ে এদিকেই আসছে। তাকে দেখার সাথে সাথে সবাই যেন পাগল হয়ে গেলো। দুই ঠাকুর হামলে পড়লো তার ওপর বাজপাখির মতো। প্রকাশের থালায় তখনো অল্প মিঠাই পড়ে ছিলো, সেগুলো সহ থালাটা সে মাটিতে ফেলে দৌড়ে এলো বিক্রমের কাছে। আর আমি একফাঁকে বিক্রমকে কাঁধে তুলে নিয়ে নাচতে শুরু করলাম। সবাই মিলে জয়ধ্বনি দিচ্ছে। কিন্তু কেউ জানতে চাইছে না লটারির ফলাফল কী ! বড়ো ঠাকুর আকাশের দিকে মুখ তুলে চিৎকার করে বললেন, ‘জয়, রাজা রামচন্দ্রের জয়!’
ছোটো ঠাকুর আরো জোরে বললেন, ‘জয়, হনুমানের জয়!’প্রকাশও তার ভক্তি জাহির করলো: ‘তুফান বাবার জয় হোক!’
বিক্রম সবার দিকে তাকিয়ে বললো, ‘আলাদা আলাদা দাঁড়িয়ে বলো দেখি সবাই, যার নামে লটারি উঠবে সে আমাকে একলাখ টাকা দেবে। বলো, রাজি?’
বড়ো ঠাকুর বিক্রমের হাত ধরে বললেন, ‘আগে বল্ কার নাম উঠেছে!’
‘জি না,’ বিক্রম জবাব দিলো। ‘আগে বলুন, আমার শর্তে সবাই রাজি?’ছোটো ঠাকুর রেগে গিয়ে বললেন,‘শুধু নাম বলার জন্যে একলাখ? শাবাশ!’
প্রকাশও গলা চড়িয়ে বললো, ‘আমরা কি ডাকঘর চিনি না?’
‘আচ্ছা ঠিক আছে, যার যার নাম শোনার জন্যে তৈরি হয়ে যাও তবে!’
সবাই অ্যাটেনশন হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো।‘হুঁশ-জ্ঞান ঠিক রেখো সবাই।’সবাই পূর্ণ সচেতন হয়ে, কান সজাগ করে দাঁড়ালো।‘আচ্ছা, তো মন দিয়ে শুনুন সবাই। এই শহরের মানুষের বড়ো দুর্ভাগ্য, শুধু এই শহরের নয়, সমগ্র ভারতবাসীর দুর্ভাগ্য! লটারি জিতেছে আমেরিকার এক হাবশি লোক।’
‘মিথ্যে কথা!’ হুংকার দিয়ে উঠলেন বড়ো ঠাকুর।
‘ডাঁহা মিথ্যে কথা!’ছোটো ঠাকুরও যোগ দিলেন তার সাথে, ‘এটা কিছুতেই সত্যি হতে পারে না। তিনমাসের একনিষ্ঠ প্রার্থনা কিছুতেই বিফল হতে পারে না।’
‘হাত-মাথা ফাটিয়েছি কি এমনি এমনি, মশকরা করছিস, অ্যাঁ?’ প্রকাশের ক্ষিপ্ত উক্তি।এরকম আরো জনা পঁচিশেক লোক উদয় হলো কাঁদো-কাঁদো চেহারা নিয়ে। তারাও আসছে ডাকঘর থেকে, নিজেদের স্বপ্নের সমাধি রচনা করে।‘নিয়ে গেছে সব লুট করে, হারামজাদা হাবশি! বদমাশ, শয়তান!’ প্রলাপ বকছে সব ক্লান্ত শ্রান্ত হতাশ মানুষ ।বিশ্বাস না করার আর কোনো উপায় নেই। বড়ো ঠাকুর হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে ছুটে গেলেন মন্দিরের দিকে। পুরোহিতকে ডিসমিস করে দিয়ে বললেন, ‘এজন্যে এতোদিন ধরে পালছি আপনাকে? হারাম খেয়ে খেয়ে চর্বি বাড়ানোর জন্যে?’
ছোটো ঠাকুরকে দেখে মনে হচ্ছে কেউ তার কোমর ভেঙে দিয়েছে। দু’-তিনবার কপাল চাপড়ে রাস্তার মাঝখানেই বসে পড়লেন। কিন্তু প্রকাশের অবস্থা আরো ভয়ংকর। ক্রোধে অন্ধ হয়ে সে লাঠি হাতে ছূটে গেলো তুফান বাবার আস্তানার দিকে। আজ তুফান বাবাকেই মেরামত করা হবে।ঠাকরুন বললেন, ‘আমি কিছুতেই মানতে পারছি না। নিশ্চয়ই সবাই বেঈমানী করেছে। দেব-দেবতার আর কী দোষ! তাঁরা কি অন্যদের হাত থেকে ছিনিয়ে আনবেন?’রাতে কেউ খাবার মুখে দিলো না। আমি উদাস হয়ে বসে ছিলাম। বিক্রম এসে বললো, ‘চলো হোটেল থেকে কিছু খেয়ে আসি। আজ তো চুলা-ই জ্বলে নি ঘরে।’
আমি বিক্রমকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘আচ্ছা তুমি যখন ডাকঘর থেকে ফিরে এলে তখন তোমাকে খুব খুশিখুশি লাগছিলো। ব্যাপারটা কী?’
‘আমি যখন ডাকঘরের সামনে হাজার হাজার লোকের ভিড় দেখতে পেলাম, তখন আমাদের পরিবারের লোকদের বোকামির কথা ভেবে ভীষণ হাসি পেলো। একটা শহরে যেখানে এতো লোক টিকেট কিনেছে, সারা হিন্দুস্তানে তো এর চেয়ে হাজারগুন বেশি হবে। আর সারা দুনিয়ার কথা ভাবো, লাখোগুন বেশি হবে না! আর আমি কিনা পর্বতপ্রমাণ আশা নিয়ে দৌড়ে গেলাম ডাকঘরে! যেই ফলাফল ঘোষণা করলো, আমার বিষম হাসি পেলো। এ যেন কোনো দানশীল ব্যক্তির তামাশা: একমুঠো ভাত নিয়ে যে ছড়িয়ে দিয়েছে লাখো লোকের মাঝে। আর আমাদের এখানে লোকজন কতো কিছু যে....'
আমিও হেসে ফেললাম ওর কথায়। বললাম, ‘ঠিকই বলেছো, আমরা দু’জনও লেখাজোকা করে নেওয়ার জন্যে কতো না বাড়াবাড়ি করেছি! আচ্ছা, একটা কথা সত্যি করে বলো তো, তোমার নিয়ত কি আসলেই খারাপ ছিলো?’
‘কী করবে এখন আর জেনে,’ মুচকি হেসে বললো বিক্রম। ‘রহস্যটা পরদার আড়ালেই না হয় ঢাকা থাক!'
.................

কোন মন্তব্য নেই: