বুধবার, ২০ জুন, ২০০৭

বেচাকেনা

মূল: গি দ্য মোপাসাঁ
রূপান্তর: মোসতাকিম রাহী
......................................................................................................................
লেখক পরিচিতিঃ কবি ঔপন্যাসিক গল্পকার মপাসাঁ ১৮৫০ সালের ৫ অগাস্ট ফ্রান্সে জন্মগ্রহণ করেন। ১৮৬৯ সালে প্যারিসে তিনি আইন বিষয়ে লেখাপড়া শুরু করেন, কিন্তু শীঘ্রি তাঁকে সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে হয় ফ্রাঙ্কো-প্রুশিয়ান যুদ্ধের কারণে। এরপর ১৮৭২ থেকে ১৮৮০ সাল পর্যন্ত তিনি সিভিল সার্ভেন্ট হিসেবে প্রথমে মিনিস্ট্রি অভ ম্যারিটাইম অ্যাফেয়ার্স এবং পরে মিনিস্ট্রি অভ এডুকেশন-এ কাজ করেন। ১৮৮০ সালে একটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশের মধ্যে দিয়ে তাঁর সাহিত্যজগতে পদার্পন। মাত্র একদশক সাহিত্যচর্চার সুযোগ পান মপাসাঁ, এই সংক্ষিপ্ত সময়ে তিনি তিনশো ছোটো গল্প, ছয়টি উপন্যাস, বেশকিছু কবিতা এবং তিনটি ভ্রমণকাহিনী লেখেন। দুর্ভাগ্যবশত তারুণ্যের শুরুতেই তিনি সিফিলিস রোগে আক্রান্ত হন, যা তাঁকে ধীরে ধীরে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করে তোলে। শেষে মারাত্মক মানসিক বৈকল্যের শিকার হয়ে ১৮৯২ সালের ২ জানুয়ারি কন্ঠনালি কেটে আত্মহত্যার চেষ্টা করেন। পরে গুরুতর আহত অবস্থায় তাঁকে প্যারিসের একটি প্রাইভেট অ্যাসাইলামে ভরতি করা হয়, এবং সেখানেই পরের বছর অর্থাত্ ১৮৯৩ সালের ৬ জুলাই মাত্র ৪৩ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন এই প্রতিভাবান সাহিত্যিক।
.....................................................................................................................

মিসেস ব্রুমেঁকে পানিতে চুবিয়ে মারতে চাওয়ার অপরাধে গ্রেফতারকৃত দুই আসামি -সিসেয়ার ইজাডোর ব্রুমেঁ এবং প্রসপার নেপোলিয়ন কর্নুকে ফৌজদারি আদালতে হাজির করা হয়েছে বিচারের উদ্দেশে। মিসেস ব্রুমেঁ অভিযুক্ত সিসেয়ার ব্রুমেঁর স্ত্রী।
ব্রুমেঁ এবং কর্নু - দরিদ্র দুই গ্রাম্য কৃষক -পাশাপাশি বসে অপেক্ষা করছে আদালতের পুরনো বেঞ্চে। প্রথমজন বেটেখাটো,মোটা, হাত-পাগুলো ছোটো-ছোটো আর ফুটবল সদৃশ গোল মাথাটি মনে হয় কেউ চেপে বসিয়ে দিয়েছে তার চর্বিবহুল ধড়ের ওপর, ঘাড় বলতে কিছু নজরে আসে না। টকটকে লালমুখে অসংখ্য ব্রণ। ছোটো একটা শুয়োরের খামার ছিলো তার একমাত্র আয়ের উৎস । বাস করতো ক্রিকেতো জেলার ক্যাশিভিল-লা-গোপিল গ্রামে ।
কর্নু হালকা-পাতলা মাঝারি উচ্চতার মানুষ, হাতজোড়া লিকলিকে লম্বা। মাথা সামান্য ঝুঁকে থাকে, বাঁকা চোয়াল, ট্যারা চোখ। হাঁটু পর্যন্ত লম্বা, নীল রঙের একটা জামা পরে আছে সে। মাথার হলুদ রঙের কয়েকগাছি চুল খুলির সাথে লেপ্টে আছে, যা তার চেহারায় ভীতিকর বুড়োটে ভাব এনে দিয়েছে। লোকজনের কাছে সে ‘হরবোলা’ হিসেবে পরিচিত, কারণ গির্জার উপাসনা সংগীত থেকে শুরু করে সাপের আওয়াজ পর্যন্ত হুবহু নকল করতে পারতো সে। আর এ কারণে লোকজন চার্চের ধর্মীয়সভায় যোগ দেওয়ার চেয়ে কর্নুর মদের দোকানে হাজিরা দিতে বেশি পছন্দ করতো।
মিসেস ব্রুমেঁ সাক্ষীর জন্যে রাখা বেঞ্চে বসে ছিলো। হালকা-পাতলা শরীর, সাধারণ চেহারা, একজন কৃষকের বউয়ের যেরকম হওয়ার কথা। তাকে দেখে মনে হয় সারাক্ষণ ঝিমুচ্ছে । হাঁটুর ওপর হাত রেখে,নির্বাকদৃষ্টিতে শূন্যে তাকিয়ে ছিলো সে।
জজ তার জিজ্ঞাসাবাদ চালিয়ে যাচ্ছিলেন। ‘তারপর, মিসেস ব্রুমেঁ, তারা আপনার বাড়িতে এলো এবং আপনাকে পানিভর্তি একটা পিপের মধ্যে ফেলে দিলো···, এরপর কী ঘটলো, দাঁড়িয়ে বলুন।’
মহিলা উঠে দাঁড়ালো। বাঁশের মতো লম্বা সে ,শাদা একটা গোল টুপি পরে আছে মাথায়, যা দেখে পতাকা টাঙানো বাঁশের কথা মনে পড়ে। কম্পিত স্বরে, মনে করার চেষ্টা করতে করতে বলতে শুরু করলো সেঃ ‘আমি শিম কুটছিলাম, এমন সময় তারা বাড়িতে ঢোকে। তাদের দেখে আমার সন্দেহ হলো, কারণ তাদের মোটেও স্বাভাবিক মনে হচ্ছিলো না। মনেমেনে ভাবলাম, নিশ্চয়ই কোনো শয়তানি বুদ্ধি পাকিয়েছে দুটোতে মিলে। ‘তারা আমাকে আপাদমস্তক দেখছিলো,বিশেষ করে কর্নু, ট্যারা চোখে হাঁ করে দেখছিলো আমাকে। এই দুই কুঁড়ের বাদশার একসাথে চলাফেরা পছন্দ করতাম না আমি। জিজ্ঞেস করলাম,‘কী চাও এখানে?’তারা কোনো উত্তর দিলো না। আমার সন্দেহ ঘনীভূত হলো।’
এমন সময় বউয়ের কথার মাঝখানে বাধা দিয়ে ব্রুমেঁ বললো,‘আমি তখন মাতাল ছিলাম !’
তখন কর্নু ব্রুমেঁর দিকে ফিরে ফিসফিস করে বললো,‘বলো না,দোস্ত,আমরা তখন পুরোপুরি টাল ছিলাম,আমাদের হুঁশ ছিলো না তখন। আর এ কথা মিথ্যেও নয় !’
তখন জজ জিজ্ঞেস করলেন,‘তোমরা তখন মাতাল ছিলে ?’
ব্রুমেঁ: জি, ধর্মাবতার, এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই।
কর্নুঃ মদ খেলে কে না মাতাল হয়!
জজ মিসেস ব্রমেঁর দিকে দিকে ফিরে বললেন,‘ আপনি আপনার বক্তব্য শেষ করুন, মিসেস ব্রুমেঁ।’
মিসেস ব্রুমে আবার বলতে শুরু করলো,‘ব্রুমেঁ আমাকে জিজ্ঞেস করলো,‘তুমি কি একশো সৌস কামাতে চাও?’
আমি বললাম,‘হ্যাঁ,চাই।’ কেননা একশো সৌস উপার্জন করা চাট্টিখানি কথা নয়। তখন সে আবার বললো,‘তাহলে ভালো করে দেখো,আমি কী করি ! আর আমি যা বলি ঠিক তাই তোমাকে করতে হবে।’ তখন সে বৃষ্টির পানি ধরার জন্যে ঘরের এককোণে রাখা একটা পিপে টেনে এনে রান্নাঘরের গালিচার ওপর রাখলো। আমাকে বললো,‘পানি এনে এটা ভর্তি করো!’ আমি দুটো বালতি নিয়ে কুয়ো থেকে পানি এনে পিপেটা ভরতে শুরু করলাম। প্রায় একঘন্টা লাগলো পিপেটা ভরতি করতে,কারণ পিপেটা একটা চৌবাচ্চার মতোই বড়ো ছিলো। এই একঘন্টা ওরা লাগাতার মদ গিলে যাচ্ছিলো। যখন আমি বললাম,‘তোমরা দেখি গলা পর্যন্ত গিলে বসে আছো।’
তখন ব্রুমেঁ বললো,‘চিন্তা কোরো না,আমরা ভালো আছি,তুমি নিজের কাজ শেষ করো। তোমাকেও সুযোগ দেওয়া হবে।’

‘যখন পিপেটা কানায়-কানায় ভরতি হয়ে গেল,তখন ওদের বললাম,‘কাজ শেষ।’
কর্নু আমাকে একশো সৌস বের করে দিলো। ব্রুমেঁ বললো,‘তুমি কি আরো একশো সৌস কামাতে চাও ?’
আমি বিস্ময় চেপে বললাম,‘হ্যাঁ, চাই।’
আমার জবাব শুনে ব্রুমেঁ বললো, ‘তাহলে তোমার কাপড় খুলে ফেলো !’
‘কী ! কাপড় খুলে ফেলবো ?’
‘হ্যাঁ।’
‘সব?’
‘বেশি লজ্জা লাগলে ভেতরের শেমিজটা রাখতে পারো। আমরা রাগকরবো না।’
একশো সৌস কম টাকা নয় যে পথেঘাটে কুড়িয়ে পাওয়া যাবে! তাছাড়া এই দুই অপদার্থের সামনে নগ্ন হতে আমার মোটেও লজ্জা করছিলো না। আমি একেএকে আমার টুপি,জ্যাকেট,স্কার্ট এবং জুতা খুলে ফেললাম। মোজা খুলতে চাইলে ব্রুমেঁ বললো,‘মোজা খোলার দরকার নেই,তুমি ওটা রাখতে পারো, আমরা ভদ্রলোক।’
সায় দিয়ে কর্নুও বললো,‘হ্যাঁ হ্যাঁ,আমরা ভদ্রলোক।’
আর এভাবে প্রায় নগ্ন হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। ওরা চেয়ার থেকে ওঠে দাঁড়ালো, কিন্তু নেশার প্রভাবে ঠিকমতো খাড়া হতে পারছিলো না।
আমি মনেমনে ভাবলাম,‘ব্যাপারটা কী?’
তখন ব্রুমেঁ কর্নুকে বলল ‘তুমি তৈরি?’
কর্নু বলল ‘হ্যাঁ।’
তারপর তারা দু’জন আচমকা আমাকে ধরে উঠিয়ে নিলো। ব্রুমেঁ আমার মাথা ধরলো,আর কর্নু ধরলো পা। আমি চিৎকার করতে শুরু করলাম। তখন ধমক দিয়ে ব্রুমেঁ বলল,‘চুপ থাক, বেয়াদ্দপ মেয়েছেলে!’
তাপরপর তারা আমাকে পিপের ভেতর ফেলে দিলো। রক্ত হিম হয়ে গেল আমার। ভয়ে অন্তরাত্মা কেঁপে উঠলো।ব্রুমেঁ বললো,‘খেল খতম?’
কর্নু বললো,‘হ্যাঁ।’
ব্রুমেঁ বললো,‘মাথা তো এখনো বাইরে রয়ে গেছে,মাপতে সমস্যা হবে।’
‘পানিতে চেপে ধরলেই তো ল্যাঠা চুকে যায়,’ সমাধান বাতলে দিলো কর্নু।
ব্রুমে আমার মাথাটা চেপে ধরলো, যেন সে আমাকে চুবিয়ে মারতে চায়। নাকেমুখে পানি ঢুকে বিষম খেলাম আমি,নিশ্বাস বন্ধ হয়ে মনে হলো মারা যাচ্ছি। মাথা তুলতে চাইলাম,কিন্তু সে আবার চেপে ধরলো আমার মাথা। প্রাণভয়ে ধ্বস্তাধ্বস্তি শুরু করলাম ছাড়া পাওয়ার জন্যে। এবার বোধহয় সে ভয় পেয়ে গেল। তাড়াতাড়ি আমাকে বাইরে বের করে আনলো, বললো,‘যা, হারামজাদি, কাপড় পরে আয়!’
ভয়ে-আতঙ্কে তখন আমি দিশেহারা। সুযোগ পেয়ে পড়িমরি করে দৌড় দিলাম। একছুটে একেবারে গাঁয়ের ডাক্তারের বাড়িতে। ডাক্তার আমাকে তাড়াতাড়ি তাদের চাকরানির একটা স্কার্ট এনে দিলেন; কারণ প্রাণ বাঁচানোর তাগিদে আমি কাপড়চোপড় ছাড়াই পালিয়ে এসেছিলাম। এরপর ডাক্তার গাঁয়ের চৌকিদার মাইত্রে শিকোকে খবর দিতে গেলেন। তারপর শিকো পুলিশ নিয়ে আসলো ক্রিকেতো গিয়ে ।
বাড়ি ফিরে আমরা দেখলাম,দুজনে তখন ঝগড়া করছে। ব্রুমেঁ চিত্কার করছিলোঃ‘এটা ঠিক নয়! এতে কম করেও আরো এক ঘনমিটার পানি ধরবে, আমার কথা শোন,তোর হিসেবে ভুল আছে।
উল্টো কর্নু চেচিয়ে বললো,‘চার বালতি পানিতে আধা ঘনমিটারের বেশি হবে না, তুই চোপা বন্ধ কর,মাথামোটা,আমার হিসেবই ঠিক!’
‘এরপর পুলিশের দারোগা তাদের দুজনকে গ্রেফতার করলো। ব্যস,এটুকুই আমার বলার ছিলো।’
এই বলে সে বসে পড়লো। আদালতে উপস্থিত লোকজন হাসছিলো ওর বক্তব্য শুনে। জুরিরা হতাশ দৃষ্টিতে একে-অপরের দিকে তাকাচ্ছিলেন।
জজ বললেন,‘বিবাদী কর্নু, মনে হচ্ছে এসব তোমারই শয়তানি! তোমার কিছু বলার আছে এ ব্যাপারে?’
কর্নু উঠে দাঁড়ালো। বললোঃ ‘ধর্মাবতার, আমি তখন নেশায় বুঁদ ছিলাম!’
গম্ভীর হয়ে জজ বললেন,‘তাতো দেখতেই পাচ্ছি,তারপর কী হলো বলো।’
‘জি,বলছি। প্রায় ন’টার দিকে ব্রুমেঁ আমার কাছে আসে। দুই পেগ মদের অর্ডার দিয়ে বলে,‘একটা তোমার জন্যে।’ আমি অবাক হলাম না - কারণ মদ্যপানের ব্যাপারে লোকজন সাধারণত দিলদরিয়া হয় -ওর সাথে বসে টানতে শুরু করলাম। এরপর আমিও তাকে এক পেগ খাওয়ালাম আমার পক্ষ থেকে। সে আবার আমাকে খাওয়ালো। এভাবে চললো প্রায় দুপুর পর্যন্ত, আকন্ঠ মদ গিলে আমরা তখন পুরোপুরি মাতাল।’
‘এরপর ব্রুমেঁ হঠাৎ কাঁদতে শুরু করলো। ওর কান্না দেখে আমার বুকটা মোচড় দিয়ে উঠলো। কী হয়েছে জানতে চাইলে সে বললোঃ ‘বৃহস্পতিবারের মধ্যে যেভাবেই হোক আমাকে এক হাজার ফ্রাঁ জোগাড় করতে হবে।’ ওর কথা শুনে আমি কিছুটা ঠান্ডা মেরে গেলাম। বুঝতে পারছেন তো,ধর্মাবতার ? এরপর ও হড়বড় করে বললো,‘আমি আমার বউকে বেচে দেবো, কিনবে তুমি?’
‘আমি তখন নেশার ঘোরে,আর আমার বউ মারা গেছে বহুদিন আগে। বুঝতেই পারছেন, ধর্মাবতার, কথাটা শুনে আমি কিছুটা অস্থির হয়ে পড়লাম। আমি তার বউকে কখনো দেখিনি,কিন্তু এটাতো ঠিক যে তার বউ একজন মহিলা,ঠিক কিনা? আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম,‘কতো হলে তুমি তোমার বউকে বেচবে?’
একথা শুনে সে চমকে উঠলো,অথবা চমকে ওঠার ভান করলো। উত্তরে সে যা বললো তা একজন মাতালই শুধু বলতে পারেঃ‘আমি তাকে ঘনমিটারের হিসেবে বেচবো!’ একথা শুনে আমি মোটেও অবাক হলাম না,কারণ আমি নিজেও তখন বদ্ধ মাতাল,আর একজন মাতালের কাছে কোনোকিছুই অসম্ভব নয়। ঘনমিটারের হিসেব আমি ভালোই বুঝতাম, আমার ব্যবসায় একহাজার লিটার মানে এক ঘনমিটার। তখনো দরদাম হয়নি।
আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম,‘এক ঘনমিটারের জন্যে কতো চাও তুমি?’
সে বললো,‘ দুই হাজার ফ্রাঁ। খরগোশের মতো খুশিতে লাফিয়ে উঠলাম আমি। ভাবলাম এই মহিলা কিছুতেই তিনশো লিটারের বেশি হবে না।
কিন্তু মুখে বললাম,‘দামটা বেশি হয়ে যাচ্ছে না?’
ব্রুমে বললো,‘এর কমে দিতে পারবো না,ভাই, লোকসান হয়ে যাবে!’
‘বুঝতেই পারছেন, ধর্মাবতার,নিজের স্বার্থ একটা মাতালও বুঝতে পারে। কিন্তু সে যদি শুয়োরের মাংস বিক্রিতে সিদ্ধহস্ত হয়, আমি তাকে সুদ্ধু বিক্রি করে দেওয়ার বুদ্ধি রাখি। হা হা হা! তো, আমি তাকে বললাম,‘যদি তোমার বউ নতুন হতো,তাহলে আমার আপত্তি ছিলো না। কিন্তু সে অনেকদিন তোমার বউ ছিলো,অর্থাৎ সে এখন আর আগের মতো খুব একটা তাজা নয়। আমি তোমাকে প্রতি ঘনমিটার পনেরো শ’ ফ্রাঁ করে দেবো, এরবেশি একটাকাও না। রাজি থাকলে বলো।’
সে বললো,‘ঠিক আছে,তা-ই সই!’
এরপর দু’জনে হাত ধরাধরি করে আমরা দোকান থেকে খুশিমনে বেরিয়ে পড়লাম। কিন্তু একটা শঙ্কা জাগলো আমার মনে,তাই ব্রুমেকে জিজ্ঞেস করলাম,‘তরল কিছুতে না ঢেলে কিভাবে তাকে তুমি মাপবে?’
‘সে তার পরিকল্পনা জানালো। বললোঃ ‘প্রথমে একটা পিপে নেবো,তারপর পানি দিয়ে সেটাকে কানায়কানায় ভরতি করবো। এরপর তাকে ওটার ভেতর ফেলে দেবো। যেটুকু পানি বাইরে পড়বে,সেটা মেপে নেবো। ব্যস,এভাবে আমরা নিঁখুত মাপ পেয়ে যাবো।’
আমি বললাম,‘বুঝেছি! কিন্তু যে-পানি বাইরে পড়ে যাবে সেটা তুমি মাপবে কিভাবে?’
‘তখন সে আমাকে বোঝাতে শুরু করলোঃ ওর বউকে পিপেতে ফেলার পর যে-পানিটুকু বাইরে পড়বে,পুনরায় সেটা ভরতি করা হবে। যেটুকু পানি ভরা হবে সেটাকে মেপে নেওয়া হবে। অর্থাৎ দশ বালতি পানি ভরলে হবে এক ঘনমিটার। দেখলেন, ব্রুমেঁ আসলে মোটেও বোকা নয় - মদ খেলেই শুধু বুড়ো ঘোড়া হয়ে যায় সে।’তো আমরা তার বাড়িতে পৌঁছলাম। একনজর তার বউকে দেখে বুঝলাম,খুশিতে বগল বাজানোর মতো রূপবতী সে নয়। দেখুন,এখানেই সে আছে। তো,তাকে দেখে মেজাজটা খিঁচড়ে গেলেও,নিজেকে সান্ত্বনা দিয়ে মনেমনে বললাম, সুন্দরী হোক আর বান্দরী,তাতে কী আসে যায়? কাজে তো আসবে! ভালো করে আরেকবার তার দিকে তাকিয়ে দেখলাম, চেহারার মতো শরীরটাও খুব একটা সুবিধের না, একেবারে রোগা-পাতলা। মনেমনে ভাবলামঃ যাক, চারশো লিটারের বেশি হবে না সে মোটেও! মদের ব্যবসা করতে করতে তরল জাতীয় দ্রব্যের হিসাব ভালোই বুঝতাম আমি। এরপর কী ঘটেছে সেটা জানিয়েছে সে আপনাকে। লোকসান হবে জেনেও শেমিজ আর মোজা জোড়া তাকে খুলতে দিইনি,কারণ আমি ভদ্রলোক। একফাঁকে সে পালিয়ে গেল।
আমি ব্রুমেঁকে বললাম,‘ব্রুমেঁ, দেখো সে পালাচ্ছে!’
‘চিন্তা কোরো না,’ বলল সে। ‘আমি তাকে ধরে নিয়ে আসবো। তাছাড়া রাতের বেলা তো তাকে ফিরতেই হবো। এসো আমরা পানিটা মেপে নিই।’এরপর আমরা পানি মেপে নিলাম। চার বালতিও হয় নি। হা হা হা! ’
হাসতে শুরু করলো কর্নু পাগলের মতো । শেষ পর্যন্ত পেছনে দাঁড়ানো সিপাহিরা বাধা দিয়ে তাকে শান্ত করলো। কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে আবার সে বলতে শুরু করলোঃ ‘তখন ব্রুমেঁ চিত্কার শুরু করলো,‘কিছুই হচ্ছে না, তোমার হিসেবে ভুল আছে!’
আমিও ক্রমাগত চেঁচাতে শুরু করলাম। এরপর সে আমাকে ঘুসি মারলো, আমিও তাকে মারলাম,সে আবার আমাকে মারলো। এভাবে কেয়ামত পর্যন্ত হয়তো আমাদের ঝগড়া চলতে থাকতো, কারণ আমরা দুজনেই ছিলাম বদ্ধ মাতাল। পরে পুলিশ এসে গ্রেফতার করে আমাদের জেলে নিয়ে গেল।’
কর্নু বসে পড়লো। ব্রুমেঁ তার অপকর্মের সহচর কর্নুর সব কথায় সায় দিলো। জুরিরা ফাঁপরে পড়ে গেলেন এই অদ্ভুত মামলার সমাধান করতে। সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্যে তারা আদালতের ভেতরের কক্ষে চলে গেলেন। প্রায় ঘন্টাখানেক পর তারা ফিরে এসে তাদের রায় শোনালেন।
দাম্পত্যজীবনের মাহাত্ম্য, দায়-দায়িত্ব আর ব্যবসায়িক আদান-প্রদানের ন্যূনতম সীমারেখা সম্পর্কে সাবধান করে দিয়ে ব্রুমেঁ আর কর্নুকে অভিযোগ থেকে খালাস দেওয়া হলো।
ব্রুমেঁ তার স্ত্রীকে নিয়ে নিজগৃহে ফিরে গেল।
আর কর্নু ফিরে গেল তার নিজের ব্যবসায়।
.....................

৩টি মন্তব্য:

নামহীন বলেছেন...
এই মন্তব্যটি একটি ব্লগ প্রশাসক দ্বারা মুছে ফেলা হয়েছে।
নামহীন বলেছেন...

মোসতাকিম রাহী,
চমৎকার অনুবাদ!
কিন্তু ছোট্ট একটা অনুরোধ করব, আপনার লেখাটা খুব বেশি ঠাসবুনুন হয়ে গেছে। লেখার মাঝে খানিকটা করে গ্যাপ দিলে পড়তে আরাম হত। এটা আমার মত।

নামহীন বলেছেন...

ধন্যবাদ, শুভ ভাই। এখন আর এই সমস্যা হয় না। আগে আনাড়ি ছিলাম তো!!