রবিবার, ২৮ ফেব্রুয়ারী, ২০১০

মণিয়া -- অমৃতা প্রীতম


মূল: অমৃতা প্রীতম
রূপান্তর: মোস্‌তাকিম রাহী
------
সন্ধ্যা নামছে। দোরঘন্টির আওয়াজ শুনে বিদ্যা বুঝতে পারলো তার স্বামী জয়দেব কাজ থেকে ফিরেছে। দরোজা খুলে অবাক হয়ে গেলো সে। জয়দেবের সাথে অচেনা, অদ্ভুতদর্শন এক লোক দাঁড়িয়ে আছে। ময়লা উদোম শরীর, গলায় লম্বা একটা জামা পেঁচিয়ে বাঁধা। বিদ্যা কিছু না বলে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তার স্বামীর দিকে তাকালো।

জয়দেব মুচকি হেসে বউকে কিছু না বলে, লোকটার উদ্দেশে বললো, ‘ইনি হলেন, এবাড়ির কর্ত্রী। খুব ভালো মহিলা। যদি তোমার কাজকর্ম দিয়ে তাকে খুশি করতে পারো, তাহলে তোমার কপাল খুলে যাবে!’
ঘরের ভেতর ঢুকতে ঢুকতে বারান্দায় পড়ে থাকা একটা চাটাই দেখিয়ে জয়দেব লোকটাকে বললো, ‘ওটা বিছিয়ে বিশ্রাম করো, আর মুখহাত ধুয়ে নাও।’
 

শোবার ঘরের দিকে যেতে যেতে এবার বিদ্যাকে বলতে লাগলো,‘তুমি এতোদিন ধরে কাজের লোকের কথা বলছিলে, রান্নাবান্নার কাজ না জানলেও যেন সৎ হয়, এমন কেউ।’
‘তাই বলে যে-কাউকে ধরে নিয়ে আসবে? কোথায় পেয়েছো এটাকে?’ বিদ্যার কন্ঠে অসন্তোষ।



‘আস্তে বলো!’ জয়দেব খাটের ওপর বসতে বসতে বললো। ‘মনু কোথায়?
‘খেলতে গেছে, এতোক্ষণে ফিরে আসছে বোধহয়। কিন্তু এই লোকটা...’


জয়দেব তাকে থামিয়ে দিয়ে বললো,‘মনুকে কিছু কথা বলা দরকার। এই লোকটা খুব সহজ সরল, একটাই শুধু সমস্যা, বাচ্চাদের খুব ভয় পায়। আমাদের দপ্তরের শর্মাবাবুর ওখানে কাজ করতো। শর্মাবাবু একে খুব পছন্দ করতেন, কিন্তু তাঁর বাচ্চাগুলো খুবই দুরন্ত। মা-বাবার বশে থাকার পাত্র নয় একটাও। পাঁচ পাঁচটা ছেলেমেয়ে তার, একটার চেয়ে একটা শয়তান! খুব বেশি লম্বা বলে বাচ্চাগুলো তাকে তালগাছ বলে খেপাতো। আর শর্মাবাবুর স্ত্রীও ছিলেন বদমেজাজি। অনেকবার সে ঘর ছেড়ে পালিয়ে গেছে, কিন্তু যাবে কোথায়? তার যাওয়ার কোনো জায়গাই নেই, আবার তাকে সেখানেই ফিরে আসতে হতো।’


‘কিন্তু তাই যদি হয়, লোকটা কি কোনো কাজ শিখতে পারবে?’ বিদ্যার সন্দেহভরা জিজ্ঞাসা।
‘আপাতত ঘরের টুকটাক কাজগুলো করাও, সাফসাফাই-বাসনকোসন ধোওয়ার কাজে লাগাও। আর মনুকে ভালোমতে বুঝিয়ে দাও, সে যেন ওর সাথে কোনো দুষ্টুমি না করে। পরে দেখবো কী করা যায়! আমাকে এককাপ চা দাও, আর লোকটাকেও দাও এককাপ।’

বিদ্যা জয়দেবের ধুয়ে রাখা পুরনো কাপড় থেকে একজোড়া ফতুয়া-পাজামা, একটা পুরনো তোয়ালে আর একটুকরো সাবান নিয়ে লোকটার কাছে গেলো। কাপড়গুলো দেওয়ার পর বিদ্যা তাকে জিজ্ঞেস করলো,‘কী নাম তোমার?’


কোনো জবাব নেই। বিদ্যা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে আবার বললো,‘উঠোনের পাশে দেয়ালের সাথে পানির কল আছে, ওখানে গিয়ে সাবান ডলে ভালো মতো গোসল করে নাও,তারপর কাপড়গুলো পরো।’


এবারও কোনো সাড়া পাওয়া গেলো না অন্যপক্ষের। মাথা নিচু করে বসেই রইলো লোকটা। ভয়ে ভয়ে একবার তাকালো বিদ্যার দিকে, তারপর আবার যে কে সেই! বিদ্যার হাত থেকে কাপড়ও নিলো না, বসা থেকেও উঠলো না।


এমন সময় জয়দেব এসে বললো,‘মণিয়া, ওঠো! বেগম সাহেবা যা বলছেন করো, কাপড় নাও আর ওখানে গিয়ে গোসল করে এসো।’
পাশ থেকে হেসে উঠলো বিদ্যা,‘তোমার নাম তো খুব সুন্দর, মণিয়া!’

মণিয়া আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়ালো বসা থেকে। বিদ্যার হাত থেকে চুপচাপ কাপড়-তোয়ালে আর সাবান নিয়ে বিদ্যার নির্দেশিত কলতলার উদ্দেশে হাঁটা ধরলো।
বিদ্যা রান্নাঘরে গিয়ে চা বানালো। বড়ো একটা গ্লাসে মণিয়ার জন্যে রেখে বাকি দু’কাপ চা নিয়ে শোবার ঘরের দিকে গেলো। আর মণিয়া যখন গোসল সেরে কাপড় পরে রান্নাঘরে এলো, বিদ্যা ওকে চায়ের কাপ দিতে দিতে অবাক হয়ে তাকালো। মুচকি হেসে চলে গেলো বড়োঘরে। জয়দেবকে গিয়ে বললো,‘ একটু এসে দেখে যাও তো মণিয়াকে, তুমি চিনতেই পারবে না! খুব সুন্দর লাগছে ওকে, আর বয়সও তো খুব বেশি না! আমি ভেবেছিলাম বুড়ো মানুষ বোধহয়!’

কয়েকদিনের মধ্যে বিদ্যা সন্তুষ্টির সাথে জয়দেবকে বলতে লাগলো, ‘খুব সাদাসিধে লোক, কোনো কথার অবাধ্য হয় না! চুপচাপ থাকে ঠিকই, কিন্তু কাজও করে ভূতের মতো, সারাদিন ঘরের সাফসাফাইয়ে লেগে থাকে। মনুর সাথে একটু আধটু কথাও বলে আজকাল। মনু তাকে তার বইয়ের ছবিটবি দেখালে খুব খুশি হয়। কিন্তু একটা ব্যাপার বুঝতে পারছি না, মণিয়া একা কোথাও বসলেই বিড়বিড় করে নিজের সাথে কথা বলতে শুরু করে। মনে হয় মাথায় একটু দোষ আছে...’

ঘরের সাথে লাগোয়া একটা নিমগাছ আছে। যখন মণিয়ার কোনো কাজ থাকে না, সে গাছটার নিচে গিয়ে বসে। আর তখন যদি কোনো লোক পাশ দিয়ে হেঁটে যায়, দেখতে পায়, মণিয়া বিড়বিড় করে কার সাথে যেন কথা বলছে, তাও আবার রাগের সাথে!


বিদ্যা ধরতে পারছিলো না ব্যাপারটা। একদিন মোটা নিমগাছটার আড়ালে দাঁড়িয়ে বিদ্যা শুনতে পেলো, দুঃখ আর ক্ষোভের সাথে মণিয়া কাকে যেন বলছে, ‘সব কাজ নিজেই করে, আমাকে কিছু করতে দেয় না! কীভাবে শাক-সবজি পাকাতে হয় আমাকে কিছুই শেখায় না; আটা পর্যন্ত মাখতে দেয় না..’


বিদ্যা আর থাকতে পারলো না, শব্দ করে হেসে উঠে গাছের আড়াল ছেড়ে বেরিয়ে এলো। মণিয়াকে বললো,‘মণিয়া, তুই রান্না করা শিখবি? আয় আমার সাথে, তোর যে শিখতে ইচ্ছে করে আমাকে বলিস নি কেন? কার কাছে নালিশ করছিস?’
মণিয়া লজ্জা পেয়ে মাথা নিচু করে নিমের ঝরাপাতা কুড়োতে লাগলো।

মণিয়া শাক-সবজি রাঁধা শিখে গেলো, আর সেই সাথে হাটে গিয়ে বাজারও করতে শুরু করলো। একদিন ঢেঁড়স আনতে গিয়ে মণিয়া প্রায় একঘন্টা পার করে ফিরলো, হাতে ছোটো ছোটো তাজা ঢেঁড়স! এমন ভাবে সে দম ফেলছিলো, যেন অনেকদূর থেকে দৌড়ে এসেছে! এসেই হড়বড় করে বলতে শুরু করলো,‘দেখুন আম্মা, কতো সুন্দর তাজা ঢেঁড়স এনেছি। আামাদের বাজার থেকে না, ঐ দূরের বড়ো বাজার থেকে।’


বিদ্যা ঢেড়সগুলো ধুয়ে চালুনিতে শুকোতে দিলো। তারপর মণিয়াকে জিজ্ঞেস করলো,‘ঢেড়সগুলো তো বেশ ভালো রে মণিয়া, কোত্থেকে নিয়ে এলি?’


মণিয়া বললো,‘এই বাজারের যে-লোকটার কাছ থেকে আপনারা সবজি কেনেন লোকটা খুব খারাপ। তার কাছে যে-ঢেঁড়সগুলো আছে তা মোটেও ভালো না, বাসি আর পোকায় খাওয়া। লোকটা সেখান থেকেই আমাকে গছাতে চাইছিলো, সাথে বিষও দিতে চাইছিলো!’


‘বিষ!’ বিদ্যা চমকে উঠলো! মণিয়ার দিকে চোখ বড়ো বড়ো করে চেয়ে রইলো। জানতে চাইলো,‘লোকটা তোকে বিষ দিতে চাইছিলো কেন?’


মণিয়া তাড়াতাড়ি বললো,‘যাতে আমি তার পঁচা ঢেঁড়সগুলো নিয়ে আসি। আরো বললো, যদি প্রতিদিন তার ওখান থেকে সবজি কিনি, তাহলে আমাকে কুড়ি পয়সা করে দেবে। এধরণের পয়সা বিষই হয়...’


বিদ্যা হাঁ করে মণিয়ার দিকে চেয়ে রইলো। বললো, ‘কে বলেছে তোকে যে, এধরণের পয়সা বিষের মতো?’


মণিয়া খুশি খুশি গলায় বললো,‘মা বলেছিলো, যখন আমি ছোটো ছিলাম। একবার একটা লোক আমাকে কিছু টাকা দিয়ে বলেছিলো আরেকজনের বাগান থেকে আম চুরি করে আনতে। আমিও চুরি করে এনেছিলাম; লোকটা আমাকে আট আনা দিয়েছিলো। আর আমি যখন মাকে গিয়ে সেই পয়সা দিলাম, মা বললো, ‘এই বিষ খাওয়ার দরকার নেই, যার পয়সা তাকে দিয়ে আয়। আর কখনো অন্যের কথা ধরে চুরি করবি না!’


বিদ্যা মমতাভরা চোখে মণিয়ার দিকে চেয়ে রইলো। জিজ্ঞেস করলো, ‘তোর মা এখন কোথায়? তাকে ছেড়ে তুই শহরে এলি কেন?’

মা’র কথা শুনে মণিয়া চুপ হয়ে গেলো। বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর বললো,‘আমার মা নেই, মরে গেছে! গ্রামে আমার কেউ নেই!’

দিন যেতে লাগলো। বিদ্যার মনে হলো এ বাড়িতে মণিয়ার মন বসে গেছে, ওদের ছেড়ে মণিয়া কোথাও যাবে না। বিশেষ করে মনুর জন্যে তার খুব টান। সুযোগ পেলেই মনুকে কাছে বসিয়ে সে গল্প শোনায়। একবার রাগ করে মনু কী কারণে যেন রুটি খেলো না, বিদ্যা লক্ষ্য করলো মণিয়াও সেদিন আর কিছু মুখে দেয়নি।

এক সন্ধ্যায় বিদ্যা আলমারি খুলে একটা সবুজ কামিজ বের করলো পরদিন সকালে সেটা পরে তাকে এক জায়গায় যেতে হবে বলে। বের করার পর সে দেখতে পেলো জামাটা কুঁচকে আছে। তাড়াতাড়ি মণিয়াকে ডেকে বললো,‘জলদি গিয়ে এটা ইস্তিরি করে নিয়ে আয়, বিন্দিয়াকে বলবি এক্ষুনি করে দিতে।’


মণিয়া গেলো ঠিকই, কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যে আবার ফিরে এলো; মুখভার! কামিজটা খাটের ওপর রেখে দিলো চুপচাপ।
বিদ্যা জিজ্ঞেস করলো,‘কী ব্যাপার, ফিরে এলি কেন?’
‘ও করে দেয়নি,’ এটুকু বলে মণিয়া তাড়াতাড়ি রান্নাঘরের দিকে চলে গেল। থালা-বাসন নিয়ে ধুতে লাগলো।
বিদ্যা বললো, ‘দিলো না কেন? তুই বলিস নি জরুরি দরকার? যা গিয়ে বিন্দিয়াকে ডেকে নিয়ে আয়।’
মণিয়া কিছু না বলে চুপচাপ নিজের কাজ করে যেতে লাগলো।

বিদ্যা আবার বলতে গেলে মণিয়া বলে উঠলো,‘সাহেব আসার সময় হয়েছে, আমাকে আটা মাখতে হবে। চাল-ডাল কিছুই এখনো রান্না হয় নি। মনু ভাইজানের জন্যে হালুয়াও বানাতে হবে। আর...’
বিদ্যা হাঁ করে মণিয়ার দিকে চেয়ে রইলো। আজ হয়েছে কী মণিয়ার! আজ পর্যন্ত সে কোনো কাজ করতে কখনো অনীহা প্রকাশ করে নি। বিদ্যা এবার কড়া গলায় বললো,‘রান্নার কাজ আমি দেখছি, তুই যা, বিন্দিয়াকে ডেকে নিয়ে আয়।’


মণিয়া বাসনগুলো এলোমেলো ফেলে রেখে উঠলো যাওয়ার জন্যে। গিয়ে ফিরেও এলো খুব দ্রুত। বললো,‘আসছে না সে, আমি বলেছি!’


মাথা নিচু করে আবার চুপচাপ বাসন মাজতে লাগলো।
বিদ্যা কিছু বুঝতে পারছিলো না। হলো কী আজ বিন্দিয়ার! সে তো এরকম কখনো ছিলো না।


এমন সময় দরোজার দিক থেকে নূপুরের আওয়াজ শোনা গেলো। একটু পর বিন্দিয়া হাসতে হাসতে ঘরে ঢুকে বললো,‘বড়ো মা,আপনি আমাকে কামিজটা দিন, এখুনি ইস্তিরি করে নিয়ে আসছি!’


‘কিন্তু হয়েছেটা কী?’ বিদ্যা জিজ্ঞেস করলো বিন্দিয়াকে।
‘মণিয়াকে জিজ্ঞেস করুন!’ বিন্দিয়া হাসতে হাসতে উত্তর দিলো।
‘সে তো কিছুই বলছে না!’


বিদ্যা কামিজ নিয়ে বিন্দিয়াকে দিলো। তারপর মণিয়ার দিকে ফিরে বললো,‘কী রে মণিয়া, তুইতো বলছিলি বিন্দিয়া ইস্তিরি করতে চায় নি, আর এখন দেখ্, সে নিজেই কাপড় নিতে এসেছে!’


জবাবে কিছুই বললো না মণিয়া, ফিরেও চাইলো না। এদিকে বিন্দিয়া হেসে লুটিয়ে পড়ছে, হাসতে হাসতে এবার বললো,‘আমি বলছি, বড়ো মা, তেমন কিছুই হয় নি। মণিয়া যখনই কাপড় নিয়ে আসতো দুষ্টুমি করে আমি তাকে বলতাম, দেখ্, অনেক কাপড় পড়ে আছে, তোর গুলো পরে করে দেবো। আর যদি এখনই করাতে চাস তাহলে তোকে একটু নেচে দেখাতে হবে!’ আর ও সানন্দে রাজি হয়ে যেতো। আর আমি অন্য কাজ বাদ দিয়ে আপনার কাপড় ইস্তিরি করে দিতাম। আজ কী হয়েছে কে জানে, যখন আমি ওকে নাচতে বললাম,ও দৌড়ে চলে এলো। আমি আসলে ওকে নাচানোর জন্যে বলেছিলাম যে, কাপড় ইস্তিরি করবো না।’


বিদ্যা চুপচাপ শুনছিলো আর হাসছিলো একটু একটু। বললো,‘তারপর?’
‘তারপর আর কী, আজ মা ওকে একটা লাড্ডুও দিয়েছিলো খেতে, কিন্তু সেটাও ফেলে এসেছে সে ওখানে।’
‘কিসের লাড্ডু দিয়েছিলো তোর মা ওকে?’
এপ্রশ্নে কিছুটা লজ্জা পেয়েছে মনে হলো বিন্দিয়াকে। লাজুক হেসে বললো,‘আজ আমার বিয়ের কথা হয়েছে, সেই লাড্ডু ওকে খেতে দিয়েছিলো মা।’


কাপড় নিয়ে চলে গেলো বিন্দিয়া। কিছুক্ষণ পর ইস্তিরি করে নিয়েও এলো। তারপর যাওয়ার সময় মণিয়াকে জিজ্ঞেস করলো,‘কী রে মণিয়া, কী হয়েছে তোর আজ? রাগ করেছিস কেন?’


মণিয়া কোনো জবাব দিলো না, চুপচাপ অন্যদিকে তাকিয়ে রইলো।


রাতে সবার খাওয়া হয়ে যাওয়ার পর মনু প্রতিদিনের মতো মণিয়াকে ডেকে তার বই থেকে ছবি দেখাতে লাগলো। কিন্তু মণিয়া এমনভাবে সবার দিকে তাকাচ্ছিলো যেন সে কাউকে ঠিকমতো চিনতে পারছে না!

সকালের চা মণিয়াই সবার ঘরে পৌঁছে দেয়,সূর্য ওঠার আগেই! কিন্তু আজ খিড়কি গলে সূর্যের আলো ঘরে ঢোকার পরও মণিয়ার দেখা নেই! বিদ্যা অবাক হয়ে তড়িঘড়ি উঠে বসলো। রান্নাঘরে গিয়ে দেখলো ওখানে মণিয়া নেই। জয়দেবও বিদ্যার পিছু পিছু উঠে আসলো, কিছুটা চিন্তিত মুখে এদিকওদিক খুঁজতে লাগলো। বিদ্যা জয়দেবকে বললো,‘তুমি চিন্তা কোরো না,নিশ্চয়ই নিমগাছের তলায় গিয়ে বসে আছে, আমি দেখছি!’


আগেরবার যেভাবে চুপিচুপি নিমগাছের আড়ােেল গিয়ে বিদ্যা মণিয়াকে দেখেছিলো, আজও সেভাবে নিমগাছের আড়ালে গিয়ে দাঁড়ালো! দেখলো সত্যি সত্যি ওখানে মণিয়া বসে আছে, মন খারাপ করে, কাঁদো কাঁদো গলায় দূরে কোথাও তাকিয়ে বলছে,‘যাও, চলে যাও! তুমিও আলসির মতো,যাও...চলে যাও!’


বিদ্যা আস্তে করে মণিয়ার পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। মাথায় আলতো করে হাত রেখে তাকে জিজ্ঞেস করলো,‘আলসি কে, মণিয়া?কোথায় চলে গেছে সে?’


মণিয়া বোবাদৃষ্টিতে দূরের দিকে তাকিয়ে আছে, তার পাশে যে বিদ্যা দাঁড়িয়ে আছে, সে ব্যাপারে তার কোনো হুঁশ নেই। বিদ্যা আবার জিজ্ঞেস করলে সে বিড়বিড় করে বলতে শুরু করলো,‘ও আমার খেলার সাথি ছিলো, আমরা দু’জন নদীর পারে একসাথে খেলা করতাম। মাঝেমাঝে ও আমাকে বলতো নদীর ওপারের বরইগাছ থেকে বরই পেড়ে আনতে। আমি সাঁতরে গিয়ে বরই নিয়ে আসতাম...’


‘কোথায় গেছে সে?’ বিদ্যার আওয়াজ ধমকা হাওয়ার মতো তার কানে যেতেই সে বলতে শুরু করলো:
‘আলসির বিয়ে হয়ে গেছে, ও আমাকে ফেলে চলে গেছে!’
বিদ্যা মণিয়ার কাঁধে হাত রেখে বললো,‘আচ্ছা, এখন ওঠ্!’ মণিয়া কিছু না বলে আবার আগের মতো দূরে তাকিয়ে রইলো।


বিদ্যা আবার জিজ্ঞেস করলো,‘আলসি যাওয়ার সময় তোকে কিছু বলে যায় নি?’
মণিয়া গায়ের ওপর ঝরে পড়া নিমের পাতা মুঠোয় নিতে নিতে বললো,‘এসেছিলো,বিয়ের লাড্ডু দিতে,’ মুঠোয় পিষে ফেলা নিমের পাতাগুলো মাটিতে ছড়িয়ে দিতে দিতে আবার বললো,‘আমাকে খুব লাড্ডু খাওয়াতো!’


বিদ্যা তার মাথায় ঝরে পড়া নিমের পাতা সরাতে সরাতে বললো,‘আচ্ছা ঠিক আছে, এখন ওঠ্। ঘরে গিয়ে চা বানা আমাদের জন্যে।’
মণিয়া একান্ত অনুগতের মতো উঠে দাঁড়ালো।

ছুটির দিন হিসাবে জয়দেব-বিদ্যার কোথায় যেন যাওয়ার কথা। সকালের নাশতা সেরে দু’জন বেরিয়ে গেলো মনুকে মণিয়ার কাছে রেখে। দুপুর পার করে দু’জন যখন বাড়ি ফিরে এলো,দেখলো মনু একাএকা খেলছে,কোথাও মণিয়ার ছায়া পর্যন্ত নেই। মনুকে জিজ্ঞেস করতেই সে জানালো, দুপুরে তাকে খাইয়ে কোথায় যেন গেছে মণিয়া, এখনো ফেরে নি।


জয়দেব মণিয়ার খোঁজে বেরোচ্ছিলো,বিদ্যা বললো,‘কোথাও খুঁজে লাভ নেই, পাবে না তুমি তাকে! চলে গেছে মণিয়া!’


জয়দেব বিদ্যার দিকে অবাক হয়ে তাকালো, জিজ্ঞেস করলো,‘কিন্তু কেন?’
বিদ্যা কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো। তারপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,‘এখন যে আরো এক আলসির বিয়ে হতে যাচ্ছে!’

<><><><>
লেখক পরিচিতিঃ কবি-কথাশিল্পী অমৃতা প্রিতম জন্মগ্রহণ করেন ১৯১৯ সালের ৩১ অগাস্ট অখন্ড ভারতের পাঞ্জাবের গুজরানওয়ালায়, যা এখন পাকিস্তানের অংশ। সমকালীন ভারতীয় সাহিত্যের পাঠকদের কাছে তিনি অত্যন্ত জনপ্রিয়। স্কুলশিক্ষক পিতার একমাত্র সন্তান অমৃতা বাবার দেখাদেখি লেখা শুরু করেন ছোটোবেলা থেকে। বাবা নিজেও ছিলেন কবি। অমৃতার প্রথম কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয় মাত্র ষোলোবছর বয়সে।
’৪৭ এর সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা দারুণভাবে দোলা দেয় অমৃতাকে। দেশভাগের সময় চলে আসেন নয়াদিল্লি। সেখানে আসার পর লেখালেখি শুরু করেন হিন্দিতে। জন্ম দেন কিছু অসাধারণ উপন্যাসের । তাঁর রচিত উপন্যাস ‘পিঞ্জর’ অবলম্বনে নির্মিত হয়েছে হিন্দি চলচ্চিত্র। ইংরেজি সহ আরো বেশ কয়েকটি ভাষায় অনূদিত হয়েছে তার সাহিত্যকর্ম।
আন্তর্জাতিক পুরস্কার সহ পেয়েছেন ভারতের সর্বোচ্চ সাহিত্যপুরস্কার ‘জ্ঞানপিঠ’, রাষ্ট্রীয় সম্মান ‘পদ্মবিভূষণ’ ও ‘সাহিত্য অ্যাকাডেমি পুরস্কার’।
প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা পঞ্চাশের অধিক। এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য-‘পিঞ্জর’,‘কোরে কাগজ’,‘আদালত’,‘উঞ্চাস দিন’,‘সাগর অউর সিপিয়াঁ’,‘নাগমণি’,‘রসিদি টিকেট’,‘কাহানিওঁ কে আঙ্গন মেঁ’।
দীর্ঘদিন অসুস্থ থাকার পর ২০০৫ সালের ৩১ অক্টোবর মৃত্যুবরণ করেন এই প্রতিভাবান সাহিত্যিক। ‘মণিয়া’ গল্পটি এখানে হিন্দি থেকে রূপান্তর করা হয়েছে।

কোন মন্তব্য নেই: