শুক্রবার, ১৯ মার্চ, ২০১০

তুষার - পাউস্তোভস্কি

তুষার
মূল: কনস্তান্তিন পাউস্তোভস্কি
রূপান্তর: মোস্‌তাকিম রাহী
-----
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ের কথা। তরুণী তাতিয়ানা পেত্রোভনা এবং তার মেয়ে ভারভারা যুদ্ধের সহিংসতা থেকে বাঁচার জন্যে অন্য অনেক শরণার্থীদের সাথে মস্কো থেকে চলে আসে ছোট একটি প্রাদেশিক শহরে। আশ্রয় নেয় বুড়ো পোতাপভের বাড়িতে। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত ওরা আসার মাসখানেক পরেই মারা যান পোতাপভ।

প্রথম দিকে অনুন্নত এই শহরটি পছন্দ না হলেও ধীরে ধীরে তাতিয়ানার শহরটি ভালো লাগতে শুরু করে। বিশেষ করে পুরো শহর যখন ধবল তুষারে ঢেকে যায়, তখন তাতিয়ানার খুবই ভালো লাগে। অদ্ভুত কিছু জিনিসপত্রে ঠাসা বুড়ো পোতাপভের বাড়িতে অভ্যস্ত হয়ে ওঠে তাতিয়ানা। পোতাপভের একমাত্র ছেলে এখন কৃষ্ণসাগরে নৌবহরে কর্মরত। বাড়ির দেয়ালে টাঙানো ছেলেটার ছবির দিকে যখন চোখ পড়ে তাতিয়ানার, মনে হয় বহুদিন আগে এই ছেলেটার সাথে কোথাও তার দেখা হয়েছে; যখন তার অসুখী দাম্পত্যকাল শুরু হয় নি; কিন্তু সে মনে করতে পারে না ঠিক কোথায়, কোন জায়গায় দেখা হয়েছে এই যুবকের সাথে!


চিঠি আসতে শুরু করে পোতাপভের নামে, সবগুলো খামের ঠিকানা একই হাতের লেখা। তাতিয়ানা চিঠিগুলো পোতাপভের টেবিলে সযত্নে ভাঁজ করে রাখে। একরাতে, যখন বাইরে তুষার পড়ছে অঝোরে, ঘুম আসছিলো না তাতিয়ানার। বারবার চোখ যাচ্ছিলো টেবিলে রাখা চিঠিগুলোর ওপর। কৌতুহল দমন করতে না পেরে শেষে একটা চিঠি খুলে ফেলে সে। চিঠিটা পোতাপভের ছেলে নিকোলাই এর লেখা। জানাচ্ছে, আহত হয়ে এখন সে হাসপাতালে আছে, সুস্থ হয়ে ছাড়া পেতে যাচ্ছে খুব শীঘ্রি। এরপরই সোজা বাড়ি চলে আসবে বাবাকে দেখতে। ফিরে এসে ঘরের অবস্থা কেমন আশা করে সেটাও লিখেছে চিঠিতে। সে আশা করছে, তুমুল তুষারপাত হলেও তাদের বাড়ির সামনের বড় গাছতলা পর্যন্ত পথটা পরিষ্কার করা থাকবে! পুরনো পিয়ানোটা শেষমেষ ঝেড়েমুছে ঠিকঠাক করে রাখা হবে এবং সবসময়ের মতো তাতে চিকোভস্কির 'দ্য কুইন অভ স্পেইড্স্' বাজবে। বাতিদানে থাকবে জ্বলন্ত মোমবাতি । সে আরও বিস্মিত হবে তাদের দোরঘন্টি ঠিকঠাক কাজ করছে দেখে!

তাতিয়ানা বুঝতে পারলো,যে-কোনো দিন বুড়োর ছেলে ফিরে আসতে পারে। আর এসে যদি দেখে তার কাঙ্ক্ষিত জিনিসগুলো একটাও জায়গা মতো নেই, তার ওপর অচেনা দুজন মানুষ দখল করে আছে তাদের বাড়ি, তখন সে খুবই কষ্ট পাবে। পরদিন সকালে, তাতিয়ানা আর ভারভারা মিলে বাড়ির সামনের পুরনো গাছতলা পর্যন্ত রাস্তাটা পরিষ্কার করে রাখলো। দোরঘন্টিটা মেরামত করে একজন লোক ডেকে নিয়ে আসলো পিয়ানোটা ঠিক করার জন্যে। মোমবাতি খুঁজে নিয়ে সে বাতিদানে বসিয়ে তৈরি করে রাখলো। ভারভারা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো কেন সে অন্যের জিনিসপত্র এভাবে নাড়াচাড়া করছে, আর তাকে করতে না দিয়ে সে কেন করছে! তাতিয়ানা তাকে জানালো এসব ছোটদের কাজ নয়।

নিকোলাই হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়ে রেলস্টেশন এসে পৌঁছুলো। মনে আশা, তার বাবাকে স্টেশনে দেখতে পাবে। কিন্তু স্টেশনমাস্টারের কাছে তার বাবার মৃত্যু সংবাদ পেয়ে খুবই ব্যথিত হলো সে। তার ছুটির মেয়াদ চব্বিশ ঘন্টাও নয়, তাই আর শূন্য বাড়িটাতে তার যেতে ইচ্ছে করলো না; ভাবলো বাইরে থেকে এক চক্কর বাড়িটা দেখে কাজে ফিরে যাবে। কিন্তু বাড়ির সামনে পৌঁছে যখন সে দেখতে পেল পুরনো গাছতলা অবধি তাদের রাস্তাটা কেউ পরিষ্কার করে রেখেছে, সে খুবই অবাক হলো। চিন্তিত মুখে সে দাঁড়িয়ে রইলো তুষারে পা ডুবিয়ে। এমন সময় কাঁধে কোমল একটা হাতের স্পর্শ পেয়ে পেছন ফিরে দেখলো তরুণী একটা মেয়ে তাকে বাড়িতে আমন্ত্রণ জানাচ্ছে!

বাড়ির ভেতর আরও বিস্ময় অপেক্ষা করছিলো নিকোলাইয়ের জন্যে। দোরঘন্টি কাজ করছে, পিয়ানো, মোমবাতি সবকিছু তার চাহিদা মতো সাজিয়ে রাখা হয়েছে।

হাতমুখ ধুয়ে নিকোলাই চা খেলো তাতিয়ানাদের সাথে। বাবার ব্যাপারে জানতে চাইলো অনেক কিছু। গল্প করলো অনেক রাত পর্যন্ত। তাতিয়ানা নিকোলাইকে বললো, সে যেন কোথাও দেখেছে নিকোলাইকে।

তাতিয়ানা আর ভারভারা মিলে ঝেড়েমুছে সোফা ঠিকঠাক করে দিলো নিকোলাইয়ের শোয়ার জন্যে। কিন্তু সে ঘুমোতে চাইলো না, জানালো, প্রতিটা মুহূর্ত বাবার হাতে গড়া এই বাড়িটার স্পর্শ নিয়ে কাটাতে চায়।

পরদিন ভোরে স্টেশন অবধি নিকোলাইকে এগিয়ে দিলো তাতিয়ানা। ট্রেনে ওঠার আগমুহূর্তে তাতিয়ানা নিকোলাইকে চিঠি লেখার অনুরোধ জানালো, আরও বললো, এখন তারা অনেকটা আত্মীয়ের মতোই , চিঠি লিখলে সে খুব খুশি হবে।

কিছুদিন পর নিকোলাইয়ের চিঠি পেলো তাতিয়ানা। নিকোলাই জানাচ্ছে, সে এখন মনে করতে পারছে ঠিক কোথায় দেখা হয়েছিলো তাদের। এটা ১৯২৭ সালের কথা,ক্রিমিয়ার একটা পার্কে হাঁটছিলো নিকোলাই, একটা মেয়ে বই হাতে বসে ছিলো পার্কেরই একটা বেঞ্চে। পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় মেয়েটা উঠে দাঁড়ায় এবং তার পিছুপিছু হাঁটতে থাকে। একসময় নিকোলাই দাঁড়িয়ে মেয়েটার দিকে তাকায় এবং অনুভব করে এই সে মেয়ে, যে তার জীবনটা পাল্টে দিতে পারে। তার জীবনে বয়ে আনতে পারে অনাবিল সুখ। নিয়তিই এই মেয়েকে তার কাছে পাঠিয়েছে, কিন্তু সে-সময় মেয়েটাকে সে অনুসরণ করতে পারে নি। এখন আবার নিয়তিই মেয়েটাকে তার কাছে পাঠিয়েছে। মেয়েটা যদি চায়, নিকোলাই তার জীবন উৎসর্গ করতে প্রস্তুত মেয়েটার জন্যে। বাবাকে লেখা চিঠিটা নিকোলাই দেখেছে টেবিলের ওপর পড়ে ছিলো খোলা অবস্থায়, সে তাতিয়ানাকে ধন্যবাদ জানালো বাবাকে করা সবগুলো অনুরোধ সে রক্ষা করেছে বলে।

চিঠিটা হাত থেকে নামিয়ে রাখলো তাতিয়ানা। আর মনেমনে ভাবতে লাগলো: আমি জীবনেও কোনোদিন ক্রিমিয়া শহরে যাইনি, কিন্তু তাতে কি কিছু আসে যায়?

********

লেখক পরিচিত: রেলপথ সংখ্যাতত্ত্ববিদ পিতা এবং বুদ্ধিজীবী পোলিশ পরিবার থেকে আগত মায়ের সন্তান কনস্তান্তিন জর্জিয়েভিচ পাউস্তোভস্কি। জন্মেছিলেন ১৮৯২ সালের ৩১ মে অবিভক্ত সোভিয়েত ইউনিয়নের মস্কো শহরে।


বিশ্বসাহিত্য পাঠকদের কাছে সুপরিচিত এই ভাষাশিল্পী অবদান রেখেছেন সাহিত্যের প্রায় সব শাখাতেই; কবিতা-নাটক-গল্প-উপন্যাস থেকে শুরু করে সাহিত্যসংকলন সম্পাদনা, চলচ্চিত্রের জন্যে চিত্রনাট্য এমনকি রূপকথা পর্যন্ত লিখেছেন। রুশ,পোলিশ এবং ইউক্রেনীয়, এই তিনটি ভাষায় তাঁর ছিলো অসামান্য দখল। সাহিত্যে বিশেষ অবদানের জন্যে এই মহান লেখক নোবেল পুরস্কারের জন্যে মনোনীত হন ১৯৬৫ সালে; কিন্তু সোভিয়েত কর্তাদের অসন্তোষের কারণে তিনি বঞ্চিত হন পুরস্কারপ্রাপ্তি থেকে। তাঁর পরিবর্তে সেবছর নোবেল পুরস্কার দেওয়া মিখাইল শলোখভকে।


১৯৬৬ সালে পুনঃস্তালিনীকরণের বিরোধিতা করে কমিউনিস্ট পার্টির ২৩তম সম্মেলেনে বিজ্ঞান ও শিল্পকলা'র যে ১২৫ জনেরও বেশি জনপ্রিয় ব্যক্তিত্বের স্বাক্ষল সম্বলিত চিঠি প্রেরণ করা হয়, পাউস্তোভস্কি ছিলেন তাঁদের অন্যতম। তাঁর সাহিত্যকর্মের মধ্যে স্টোরি অভ লাইফ, স্নো, ক্রসিং শিপ্‌স, দ্য ব্ল্যাক সি, সামার ডেইজ, দ্য রেইনি ডউন এবং স্টিল রিং উল্লেখযোগ্য। ১৯৬৮ সালের চোদ্দ জুলাই মস্কো শহরে মৃত্যুবরণ করেন এই প্রতিভাবান ভাষাশিল্পী। তাঁর Snow গল্পটির বাংলা রূপান্তর এখানে পত্রস্থ করা হলো।

কোন মন্তব্য নেই: